Friday, August 21, 2009

নার্স, আমি ঘুমোইনি

টোকন ঠাকুর

প্রকাশক: আরিফুর রহমান নাইম
ঐতিহ্য
রুমি মার্কেট, ৬৮-৬৯ প্যারিদাস রোড, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।

প্রথম প্রকাশ: ফাল্গুন ১৪১৪, ফেব্রুয়ারি ২০০৮
গ্রন্থস্বত্ব: বর্ষা বিভাবরী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রচ্ছদের আলোকচিত্র: রিচার্ড রোজারিও
মূল্য: একশত টাকা।



Nurse, Ami Ghumoini By Tokon Thaakoor. Published By Arifur Rahman Nayeem, Oitijjhya, Feburary-2008.
Price: Taka 1000.00 USS 4.00
ISBN 984-70193-0015-5

উৎসর্গ
আমার কোলবালিশক

মেইনস্ট্রিম বাঙলা কবিতা

সব যা তা! তা তা! থৈ থৈ!
হাতে তেমন কাজ নেই, ভাঁজ খৈ।

এর মধ্যেই কেউ লাভবান, কেউ লাভবতী
কেউ হারানো সুর, কেউ মধুমিতা
সেটাই এদেশের মেইনস্ট্রিম বাঙলা কবিতা

এরকমই

যাব না, যাব না!
যাব না বলেও কতবার গেলাম!
যতবার গ্রিন রোড
তিনগুণ-ততবার ড্রিম রোড গেলাম!

দেখব না, দেখব না!
বললাম, দেখতে চাই না!
কিন্তু চোখ আজন্ম-ধার্মিক, সে তার ধর্মে বিচ্যুত হয় না!
ভাবলাম, রাখব না! কিছুই রাখব না!
কোনও লিপি রাখব না, কারো মুখাকৃতি রাখব না!
এক একাসভামুহূর্তে, ছিঁড়েছুঁড়ে সব ফেলেও দিলাম জানলা দিয়ে
            যারা যোগ দিল বসন্তদিনের পাতাদের দলে
যদিও পড়ার ক্ষমতায় দেখার ক্ষমতায় আমার দুচোখ সাক্ষীই রয়ে গেছে

পাব না পাব না বলেও আমি
কত কী পেলাম!
পৈত্রিক পরিতাপ, বাল্যকাল জুড়ে ব্ল্যাকবোর্ড-চক-ডাস্টার-শিক্ষক...
বয়েসি-জোয়ার কিংবা প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়া পথের কৌলিন্য

পেলাম
প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে কী রোমাঞ্চকর, সিম্বলিক এক
            খড়পন্থী জীবন
মৌমাছিদের উৎপাদন-ব্যবস্থায় নিহিত মুগ্ধতাও পেলাম

লিখব না, লিখব না!
লিখব না বলেও শেষরাতে শুয়েশুয়ে কতবার লিখলাম
            নার্স, আমি ঘুমোইনি...

পাখি সম্পর্কিত শেষ কবিতা

প্রেম হলে সেই পাখি, যার সোনালি ডানা ছুঁয়ে দেখবার সৌভাগ্য পাওয়া চাই। যার একটি মায়াবী পালক খসিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। প্রেম সেই পাখি, যার চোখের মণিতে সামুদ্রিক নৌকার মাস্তুল দেখা যায়। যার মসৃণ গ্রীবায় নিঃসন্দেহে রোমিও-জুলিয়েট মঞ্চস্থ হতে পারে। প্রেম সেই পাখি, যার ঠোঁট দেখলেই প্রতীয়মাণ হয়- একজন একা মানুষের আত্মজীবনী কী ভয়ঙ্কর পিপাসার্ত! বীভৎস!

যখনই কেউ প্রেমে পড়ে মানে সেই পাখিতে পড়ে। তখন সে প্রেমরূপ পাখির ডানা ছুঁতে চায়। কারণ, তার অবচেতন মন প্রার্থনা করে ডানার নিচে আত্মগোপন। একুশ শতকের জ্বালায় জ্বলেও প্রেমে এরকম আত্মগোপন এখনো উঠে যায়নি। কিন্তু হঠাৎ কোনো পাখি যখন উড়ে যায়, ডানার নিচের ওমে যে আত্মগোপনকারী সে ধপ করে পড়ে যায়। নিঃশব্দে শব্দ হয়, ধপাস!

অর্থাৎ পাখি উড়ে গেলেই প্রেম উড়ে যায়। সেই প্রেম সেই পাখি আর সন্ধান করেও পাওয়া যায় না। এরপর যত পাখি চোখে পড়ে, সব অন্য পাখি। কোনোভাবেই আমি ভুলতে পারি না, সেই পাখি কোথায় গেল- যার অপরিসীম ডানার নিচে একদিন আত্মগোপনে ছিলাম, ওম সম্মেলন করেছিলাম...

আজ যেসব পাখি ওড়াউড়ি করছে, ডালে বসে আলস্য ভাঙছে- এরা তো জানেই না যে, প্রকাশ্যে ঘোরাঘুরি করলেও আমি আত্মগোপনে থাকতে ভালোবাসি। ফলে, এখন আমি বুঝতেই পারছি না, কোন পাখিটার ডানার নিচে ওম্ সম্মেলন সফল হবে, সার্থক হবে?

কোন পাখিটা উড়বে না আর, স্বভাব ভেঙে?

নিঃশ্বাসে রচিত কবিতা

শুধু বসন্তেই কোনও কোনও নিঃশ্বাস কবিতা হয়ে যায়।

সেই কবিতা মেঘাচ্ছন্ন লিটল ম্যাগাজিন থেকে বেরিয়ে আসমানী গ্রন্থ হবার পথে, কিছুকাল শাহবাগের আকাশ থেকে অন্যান্য আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই মিলিয়ে যাওয়া কবিতাগুলোই নিঃশ্বাসে রচিত কবিতা।

কোনও কোনও কবিতা কখনো ছাপা হয় না। সেগুলোও নিঃশ্বাসের সন্তান। হয়তো নিঃশ্বাসগুলো নিভৃতচারী, প্রেমে একপাক্ষিক, মিহিপন্থী... মুখোমুখি তাকে ধরা যায় না। আবিষ্কার করতে হয়। ছাপা না হওয়া এমন কিছু নিঃশ্বাস, এমন কিছু কবিতা আমারও আছে। কল্যাণী-কেই কান পাতলে, শোনাতে পারি। সেটা অঁলিয়স ফ্রাঁসেজে বসে শোনানো যাবে না, মুগ্ধতা ছড়ানো ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেই মিহিনিঃশ্বাসের কবিতাগুলো শোনাতে পারব। শোনাতেও চাই।

আমি জানি, আমার নাক-মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া কবিতাগুলো আলটিমেটলি কী চায়? চায় কি কেবল কি তরুণী কারও কানের কাছে নির্বাক, গ্রীষ্মপ্রধান আত্মপ্রকাশ? নাকি যন্ত্রস্থ না হওয়ার যন্ত্রণায়, এসব কবিতা প্রেমিকাকে মনে করে লিটল ম্যাগাজিন, বইকেই ভাবে বউ। যেন, যে-কেউ একজন সাড়া দিলেই সে শাদাপৃষ্টায় ঢুকে পড়তে পারবে। সঙ্গমতৃপ্ত সফল ঘুম দিতে পারবে।

এরকম মিহিনিঃশ্বাসের কবিতাকে মুখোমুখি বসে ধরা যায় না। আবিষ্কার করতে হয়। আবিষ্কার করতে কান লাগে, নির্ভুল জোছনাপীড়িত চরাচরে উৎকর্ণ কান। তাতে, মিহিনিঃশ্বাসের জন্মান্তর হয়। মুদ্রণের আকাঙ্ক্ষা জাগে। কারণ, গরম নিঃশ্বাসই কামশিল্পের বিজ্ঞাপন, লিপডিশ, যৌনবর্ধক।

এখন, এই মুহূর্তেও আমার নাক-মুখ দিয়ে মিহিনিঃশ্বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। না-ছাপা কবিতা বেরিয়ে যাচ্ছে। এই কবিতা শুনতে চাইলে অঁলিয়াস ফ্রাসেজে বসে না, ঘরে গিয়ে তোমাকে আবহাওয়া তৈরি করতে হবে।

তাছাড়া বসন্ত-নিঃশ্বাসে রচিত কবিতা চৈত্রসংক্রান্তির পর তো আর শোনাতে পারব না। ততদিনে কবিতা আত্মগোপনে চলে যাবে, বাতাসে মিলিয়ে যাবে। জানি তো ঝড়ের সম্ভাবনা বাড়লে, বাতাস নিজেও পালিয়ে যাবে। এবং আমার হারানো কবিতার সংখ্যা বাড়বে।

তাহলে, এই বসন্তে আমার নিঃশ্বাসে কয়টা কবিতা ছাপা হল? আর কতগুলো ছাপা হলো না, মিহিপন্থী বলে? ছাপা না-হওয়া কবিতাগুলো কিভাবে শোনাব, ঘরে না-গেলে, কান না-পাতলে? বাঙলা কবিতার জন্যে আপুমণিদের কি বিন্দুমাত্র দয়ামায়া নেই?

ভৈরবি

একটু আগেও কাক ছিল ডাহা রাজনীতিবিদ;
এখন, এই ভোরবেলা গলি ফেরিঅলাদের, যেন আমাদের
-কী চাই কী চাই?
কোথাকার কোন জীবনপোড়ানা সুরে, মহিলা বিকোচ্ছে-
ছাই নিবেননি ছাই... ই...

ইহাকে কি ভৈরবি বলা যায়? ভোরবেলা...

বসন্তে রচিত ভাব-ভালোবাসা

হাওয়া ধার্মিক, তার কর্তব্য ধাওয়া।
লক্ষণীয়, সম্পর্ক এসে সম্পর্কের চলে যাওয়া
পথের শেষে সূর্যাস্ত একটি ছবি, একটা ফ্রেম
একটু একটু করে জড়িয়ে যাওয়া, লোভনীয় প্রবলেম
আমাদের অভিনিবেশ দাবি করে, দেখি খা খা
একটা মাঠের মধ্যে রোদমাখা ঢিলিমিলি আঁকা
এক জ্যান্ত দুপুর, জ্যান্ত ঘূর্ণি, এক জ্যান্ত স্বপ্ন, তখন
টবেই ফুলের বাগান, ছাদে, শ্রী শ্রী ছাদই শ্রী বৃন্দাবন

ধেনু বিনে নদীহীনে, বসন্তের এ দিনে রাধারানীরা
কোথায় গো সব, দ্যাখো আমি কবিতা লিখছি, কবিতাগুলো
রাত্রিবেলার বুকের নিচে বালিশ চাপা তুলো মানে শিমুল ফুলও
তার জীবনের গল্প নিয়ে গল্প হয়ে ওঠার আশায়
আমার কাছে আসে কিন্তু প্রকাশিত হয় কবির ভাষায়

এটাই ব্যর্থতা। আর ব্যর্থকে ভালোবাসারা ভালোবাসা দিতে
পারে না বলেই ছেলেটি থাকে উত্তরায়, মেয়েটি শ্যামলীতে।

Thursday, August 20, 2009

সব কবিতার শিরোনাম লাগে না

রোদ তুই ছন্দ জানিস? মাত্রা মানিস?
সামান্য ফাঁক-ফুটো পেলেই ঢুকে পড়িস?

রোদ তোর আসার পথে দেখা হয়েছে কার কার সঙ্গে, বল?
মেঘরা ছিল কোন বৃত্তে, কথা হয়নি আমাকে নিয়ে?

পরিপার্শ্বের হাওয়া, কার কাছে তুই অক্ষরবৃত্ত শিখে হয়েছিস হিম?
কোন ছন্দে পাতা ঝরে? বলদ এবং বাঙলা বিভাগের
বিরাট অধ্যাপকের মধ্যে যবে এত অনুপ্রাস তবে এত মিল?

গান তুই হাওড়ের মাঠে শুয়েছিলি শীতকালে
তোর উস্তাদ কোন কুলাঙ্গার খাঁ?
ধান তুই আমার শব্দে বোনা ফসল
মহাজন সাহিত্য সম্পাদক?

রোদ আজ সব খুলে বল, আমি তো তোকে জানি-
ড ফুলস্টপ না করেও তুই কেমনে কবিতা লিখিস
অচেনা ম্লান-মুখে?

জোশ জোশ! চটি পড়েনি, কী নিরক্ষর! থ্রি এক্স দ্যাখেনি
কী গ্রাম্য!
চড়ুই সেক্স করছে মহাসুখে...

হাউ আর ইউ, মৃগয়া?

আমাদের স্বপ্ন ঘুম-
তার কোনো ঘর নেই
নেই কোনো দেশ;

আমাদের কবিতা-
তার তো মোটেই নেই
সংসারী অভ্যেস;

আমাদের উপন্যাস-
প্রধান চরিত্রের গন্তব্য
গাঢ় নিরুদ্দেশ;

আমাদের ছোটগল্প-
সম্পর্ক, শেষ হইয়াও
হইল না শেষ...

০২.
আমাদের শব্দ, বাক্য, ভাবে
এত যদি দূরত্বশিল্প
মন কি করে মনের কাছে যাবে?
না-গেলে
কিভাবে
ঘামে
সমুদ্রের স্বাদ পাবে?

০৩.
ধরো এই হাত,
আমার হাতও আর তোমার হাতকে ধরে বলবে না-
‘হাত তুমি ভালো আছো?’

অথচ আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী হতে চাইনি কখনো, তবু
বহুদিন তুমিও জানো না- কেমন আছি
আমিও জানি না- কেমন আছো?

বাঁচি? কিভাবে বাঁচো!

পোকা, প্রজাপতির গল্প

এখনো কবিতা পড়ো মানে তুমি মনে মনে ভাবো-
আচমকা এক ফুরফুরে বিকেলে প্রজাপতি-সম্মেলন হবে।
সেই সম্মেলনে তুমি স্বাগতিক, তোমার ব্যস্ততা থাকবে।
তুমি ফুলদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে
ঘাসের বক্তব্য শুনতে শুনতে, হয়তোবা ভুলে যাবে-
একজন কবি এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছে
পোকা থেকে তুমি প্রজাপতি হয়ে কতটা বদলে গেলে?

এখনো কেউ কবিতা লেখে মানে সেই লোকটাই কবি-
যে কি না পোকা হতে পারেনি বলেই প্রজাপতি হতে পারছে না

নয়া ফিল্ম ডিরেক্টর

ফিল্ম ডিরেক্টর মানতে নারাজ, রোদ পড়ে যাচ্ছে। সূর্যাস্ত ধরা দেবে না। ডে সিকোয়েন্স বাদ থেকে যাবে! বিকেলের ছাদের রেলিং ধরা ফ্রেমে মনমরা মেঘ আর মেঘের অ্যাসথেটিকস চিত্রিত হবে না! চল্লিশ জনের ইউনিটে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানো নিঃসঙ্গ উন্মাদের ডাকনাম ফিল্ম ডিরেক্টর। মাস্টার শটে যিশুকে রেখে পরে কেটে কেটে ক্লোজআপে পেইনফুল টেক: ফলে ফিল্ম ডিরেক্টর হচ্ছে মা, বেথেলহেমের শিশুর মা। জ্বর, ভয়াবহ জ্বর; কিন্তু কেউ তার কপালে হাত রেখে পুড়ে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের লাল গাড়ি মাটির রাস্তার গ্রাম পোড়াদহে পৌঁছতে পারে না। যিশুর মাকেই শনাক্ত করতে হয় সন্তানের ক্ষত-রক্তাক্ত, ক্রুশবিদ্ধ লাশ। যিশুর মায়ের যন্ত্রণা তো কেউই মাপে না!

নায়িকার মুড অফ! লাল বাউলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? তাহলে গোষ্ঠের গান কে গাবে? মেকআপম্যান মুড-অফ নায়িকার মুড অন করে দিল; কিন্তু শটে দাঁড়িয়ে সে সংলাপ ভুলে যাচ্ছে। অনেক অনেক বিচ্ছিন্নতার পরেও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক প্রেমিকের মৃত্যু সে আশা করেনি। এদিকে, নিরক্ষর নায়কের হাতে আদর্শলিপি। নায়ক মাত্রই ভাঁড়। আর যারা অন্যান্য... তারা ধুলোয় মিশে যাচ্ছে, দিগন্তে পালিয়ে যাচ্ছে, তারা হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাচ্ছে নিজের ছায়ার মধ্যে।

একদল ফড়িঙ কিংবা হরিণীর বদলে একটি প্রজাপতির পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ছুটতে ক্যামেরার পেছনে বসে বা দাঁড়িয়ে নয়া ফিল্ম ডিরেক্টর এন্ড লোনলি অ্যাক্টর সিনেমা বানাচ্ছে, এই বসন্তে...

কুরঙ্গগঞ্জন : হরিণের লজ্জা দেখার লোভ

বাঙলা কবিতা লিখি। লিকতে গিয়ে, হঠাৎ একটা শব্দ নিয়ে খটকা লাগে। হয়তো শব্দটার অর্থ কিছুটা আছা মতোন, আর তখনই অভিধান খুলে বসি। অভিধানে সব শব্দের মানে লেখা আছে। যেমন, কুলঙ্গি মানে হচ্ছে- জিনিশপত্র রাখার জন্য দেয়ালের মধ্যস্থিত ছোট খোপ। দিগন্তমোহে আমি মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে দেখি: নিভে যাওয়া বাল্যকাল একটি মাটির কুপি হয়ে জ্বলে জ্বলে উঠছে খোপ-কুলঙ্গিত, মামাবাড়ির সেকালের দেয়ালে... একরাতে, মা তখনও অবিবাহিত, নিরক্ষর নানীর শোবার ঘরের কুলঙ্গিতে লুকিয়ে রাখা তার একগুচ্ছ ভুল বানানে সমৃদ্ধ প্রেমপত্র ধরা পড়ে যাওয়ায়, হন্তদন্ত মামাদের সুপাত্র সন্ধান জরুরি হয়ে পড়ে। হবু বরগুলো হবু অবস্থায়-ই মরে যায়। থাক সেসব কথা, এখন কুলঙ্গি শব্দটার পরিষ্কার মানে কি- সেটা দেখবার জন্য যখন সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধান খুললাম, খুঁজছি ক... কা... কু... কুলঙ্গি খুঁজে পাওয়ার অন্তত তেইশটি শব্দ আগে চোখে পড়ল অদ্ভুত এক শব্দ, শব্দটা কুরঙ্গগঞ্জন? কুরঙ্গগঞ্জন মানে- হরিণকে লজ্জা দেয় এমন; হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট। যারা কবিতা পড়েন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি- কুরঙ্গগঞ্জন শব্দের মানে বুঝেছেন? না, আমি ঠিক বুঝিনি। কারণ হরিণকে লজ্জা দেয় এমন কোনো প্রাণী আছে- উদাহরণ হিসেবে সেটা অভিধানে নেই। কোথায় এমন এক আছে যে, তাকে দেখে হরিণ লজ্জা পেয়ে যাবে? তাছাড়া হরিণের কী নেই যা তার মধ্যে আছে? এদিকে, হরিণ থাকে সুন্দরবনে, হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট সে থাকে কোথায়? সমুদ্রে, পাহাড়ে নাকি সে থাকে মেট্রো-চাঁদের শহর শেষের দ্বীপান্তরের বাড়ি?

কুরঙ্গগঞ্জন-এর আভিধানিক অর্থ জানার পরও মাথায় নানা প্রশ্ন আসে। প্রশ্নে প্রশ্নে প্রেম ঘন হয়। ভাবি, যদি কোনো ভেরিগুড ম্যুড ছুটে আসে একদিন লেখার সময়, সে লেখায় হঠাৎ করেই বসিয়ে দেব কুরঙ্গগঞ্জন শব্দটি, হয়তো হরিণের লজ্জা দেখার লোভে, নয়তো হরিণ থেকে উৎকৃষ্ট কাউকে দেখার আকাঙ্ক্ষায়

আকাশ যেমন নীল, প্রত্যেকদিন সেরকমই কবির অভিপ্রায়...

Wednesday, August 19, 2009

বুয়াকে নিয়ে প্রেমের কবিতা-২

আকাশে, জোবেদা খালার সঙ্গে তুলনাযোগ্য চাঁদ
বিধবা কিন্তু আভা ছড়ায়

আভা ছোঁয়া মুশকিল, তবু ইনিয়ে বিনিয়ে
নৈকট্যের ছুঁতো
জোবেদা খালা ছুটা বুয়া, উদ্ভুত
এই পরিস্থিতিতে, মিডল ক্লাসের
সতীচ্ছেদ হবার ভয়;

এমনকি এরপর তারা আমার কবিতাও
আর পড়বে কিনা, আমাকেও স্পর্শ করবে কিনা
মনে প্রশ্ন, চাপা ভয়, গগুড়িগুঁড়ি ভ্যাবাচ্যাকা সংশয়

শব্দের সঙ্গে সম্পর্কের পরও...

শব্দের সঙ্গে থাকি!
কত শব্দকে কতবার, কতভাবে গ্রহণ / বর্জন করেছি
বলতে পারব না
কতবার মাস্টারবেশন?
কতেক শব্দ প্রিয় হয়ে যায়, তারা কি বন্ধুশব্দ
না নিছক আমার অনুসারি?
কতেক শব্দ পালায়, হারায়... গেরিলা হতে চায়
তাদের উদ্দেশ্যে কি সাময়িক না সুদূরপ্রসারী?
চমক আছে, বাগে আসে না এমন অনেক শব্দ চিনি, আমি শব্দচারী
কোনো কোনো শব্দ অতি খোলামেলা... উঠতি নায়িকা
কোনো কোনো শব্দ ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে গম্ভীল... মেজমামা
কোনো কোনো শব্দ উঠে আসে গ্রামগঞ্জ থেকে... ঢেঁকি বা ধানক্ষেত, নৌকাঘাট
কোনো কোনো শব্দ ‘আসব’ ‘আসব’ বলে কথা দিয়েও কিন্তু আসে না
নাকি আসতে পারে না, ভয় পায়, অথবা আমাকে পছন্দ করে না
সেই শব্দের একটি শব্দ প্রেম, একটি বুদবুদ

আবার কিছু শব্দ শেষপর্যন্ত অভিধানে থাকে না, তারা চিরকাল শরণার্থী
গ্রন্থহীন তারা গৃহহীন
সেইসব শব্দই কি আমার গরিব আত্মীয়, যাদের নিজের যাবার জায়গা নেই?
আমাকে কি তারা ভাবছে বিশাল শব্দপ্রেমিক কিংবা শব্দসওদাগর?
দ্যাখো! কীভাবে তাকিয়ে আছে নির্ঘুম, নির্বাসন, নো ম্যানস ল্যান্ড, ভাঙা বেহালা
আত্মহত্যাপূর্বক মদ, মরুজোছনা, শূন্যতায় চুম্বন ইত্যাদি শব... দো
শব্দ আসে শব্দ যায় শব্দ ফেরি করি আমি শব্দসঙ্গে আছি
কিন্তু একটি শব্দের উপস্থিতি আমি এক ইঞ্চিও মানতে পারছিনে
যথাশব্দ দূরত্ব
এই আপাতকালে নিঃশব্দসূচক সন্ত্রাসী শব্দ তুমি পাঠিয়েছ
মনোজাগতিক মহাকাশ থেকে
জানি, তোমার পাঠানো শব্দকে তুমি ছাড়া কেউ আর নড়াতে পারবে না
সরাতে পারবে না... তুমি রাণী ভবানী
তাই যতই আমি শব্দের সঙ্গে থাকি
যতই আমি হই না কেন শব্দচারী পাখি
যতই বলি, পুলিশ ডাকব, র‌্যাব ডাকব
প্রেরিত তোমার শব্দ দূরত্ব যায় না
দূরত্ব আরো বাড়ে, বাড়ে নিঃশব্দসূচক সন্ত্রাস!
অথচ আমি মুখর-মুখর শব্দফেরিঅলা- সৃজনশীল এই সাড়ে পাঁচফুট জীবনে
এগারো ফুট পরিহাস...

ভাষা-শব্দ-কবিতা-গল্প

আজ যে ভাষায় আমি কথা বলি, এই ভাষায় কবিতা লেখা সম্ভব... একথা তো জানতাম না। সত্যি, আমি বুঝতে পারিনি- কবিতায় ভাষা এত সহজ, আটপৌরে, নিরলঙ্কার হতে পারে। ধারে-কাছের শব্দগুলোও আজ অবলীলায় কবিতায় ঢুকে যাচ্ছে। কবিতা হয়ে উঠছে মুখোমুখি। যেন আজ আর কোনো আড়াল নেই, উড়াল নেই, উপমা-চিত্রকল্প নেই। বরং আজ গল্প আছে। গল্পের মুখোমুখি চোখ নাক-ঠোঁট-মুখ আজ মুখোমুখি। আজ গল্প হবে; চোখের সঙ্গে চোখের, নাকের সঙ্গে নাকের, ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের... যার যার যা ভাষা: কোনো বাধা নেই, দাদা কোনো ব্যাকরণ নেই

কথা বলার ভাষায় কবিতা লিখতে লিখতেও হঠাৎ মনে হয়, আর কথা নেই। তক্ষুণি, স্তব্ধতার ভাষায় কবিতা লিখি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল করি, স্তব্ধতাও আমার ভাষা, যথার্থ অনুবাদ ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। বাংলা একাডেমি থেকে কত ভাষা-শব্দ গবেষণা হচ্ছে, তারাও আমার স্তব্ধতা নিয়ে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাষা নিয়ে, দীর্ঘশ্বাসগুচ্ছের উৎপত্তি-বুৎপত্তি নিয়ে কিছু করছে না।

অথচ একদিন! কবিতার ভাষার জন্য আমিস কত শাস্ত্রগ্রন্থ, অভিধান-কবিধান-ছবিদান তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি; পাখির নীড়ের মতো বলতে না পারলেও বলার চেষ্টা করেছি- নীড়ের পাখির মতো... একদিন কবিতার ভাষার জন্য সারামাঠে ছড়ানো রোদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, পতেঙ্গার সড়কের ঝাউবনের ছায়াসব কুড়োতে কুড়োতে, মনে যত পুঞ্জিত ভাব, সম্প্রসারণ করতে করতে, মহাকাশব্যাপী শূন্যতা পূরণপূর্বক এক একটা শব্দ ধরে বাক্য গঠনের চেষ্টা করেছি। নদীঘাটে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখেছি স্নান... দেখেছি, নদীর জল কারো নাম রাখে না মনে

কত আঁকাবাঁকা পথ, পথের পাশের ঝোপজঙ্গল আমি মাত্রায় ফেলে লিখে গেছি বাংলা ভাষায়, শব্দে-কবিতায়; আততায়ী জোসনায় আমি নারীদিগন্তের দিকে হাঁটতে হাঁটতে শুনে ফেলি- মোরগের গলায় ভোর... সেই শব্দ, সেই ভাষা-সিম্বল ছেড়ে-ছুঁড়ে, আজ মুখের ভাষায় কবিতা লিখব বলে, এই বসলাম, মুখোমুখি, তোর

গল্প হবে, চোখের সঙ্গে চোখের, ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের, জিহ্বার সঙ্গে...?

ত্রিদিব দস্তিদার মারা যাবার পর

বেলাল চৌধুরীর ফোন, হ্যালো টোকন...

একটা শোক, একটা ইনফরমেশন! আমার বাসায় আমি আর কয়েকটা চড়ুই, রুম ভাগাভাগি করে শুই ভোরের চড়ুই আমাকে ডাকে কিন্তু আমি তো ঘুমাই, মনে একটা শালিক ছিল, তাও এখন নাই। তাই ঘুমোচ্ছিলাম, সকাল ছটায় বেলাল চৌধুরীর ফোন... অনেকদিন পর তখন, সেই মুহূর্তে ফিরে এল শালিকের মন!

বেলাল চৌধুরী বললেন, ‘গতরাতে ত্রিদিব এক্সপায়ার করেছে... ওর তো কেউ নেই, সৎকার করারও কেউ নেই, বন্ধুদের জানিয়ে দাও আর তুমি এক্ষুণি চলে আসো নয়াপল্টনে জোনাকির কাছে...’

প্রেসক্লাব যাই, গিয়ে দেখি ত্রিদিব দা নাই তবে বহুদিন আগে, পটিয়া থেকে এই শহরে ঢুকে-পড়া নিঃসঙ্গ এক জিপসি-কবির ডেডবডি পড়ে আছে, যদিও ‘ওর তো কেউ নেই, সৎকার করারও কেউ নেই’ এই মমতা সত্য নয়- কারণ, আরো পঞ্চাশজন আসঙ্গ নিঃসঙ্গতাপ্রার্থী তখন লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা কারা? কেউ নয়?

শেষরাতে বৃষ্টির পর ভীষণ মেঘ হয়ে থমকে ছিল মৌরি। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, সব্বাইকে বলি: দাহপূর্ব দেহ থেকে শাদাকাপড় সরাও, কেননা, ছাই হবার আগেই আমি দেখতে চাই- একদিন কবি যা জানিয়েছিলেন- অঙ্গে আমার বহুবর্ণের দাগ...

Sunday, August 16, 2009

ফুল-সম্ভবা কুঁড়ি ভেতর

খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাচ্ছি।
এই! গ্রামান্তের তালগাছ, শোনো-
একদিন, মাটি থেকে দাঁড়ানো মাথার উপরের
শূন্যতা ছুঁয়ে ফেলব-
এই ধরনের একটি ভাবনাই আমাকে অখণ্ড করে রেখেছিল
এই ধরনের একটা স্বপ্নই একদিন...

আজ ভাবনার সঙ্গে মিল না হবার দিন
শূন্যতা ঘুচে যাবার দিন
অনেক অনেক ছবি এঁকে শূন্যতা ভরে ফেলবার দিন
ছবির মধ্যে ইচ্ছেমতোন রং মাখবার দিন
আজ আর আমার অখণ্ডতা-অঙ্গিকার নেই।
তালগাছ তুমি কোথায়? ক্ষম: গো দিগন্তপ্রেতিনী
অনেকদিন হলো আকাশের নিচে দাঁড়ানো হয় না
টাইম নেই
বহুকাল পরে গতকাল মনে হলো, সন্ধ্যার বিয়ের পর
সেই রাতের আত্মরতিরই স্রেফ আত্মহত্যা থেকে
সেইফ করে দেয় আমাদের তিন বন্ধুকে- দুইজন পরে
রিহাবে গেছে

এরপর ভ্রমণকাহিনী- হারাগাছ থেকে হাভানা,
তামাক ভূমির আগুন
এরপর আমরা যে যার মতো... যে যার গুপ্ত-প্রকাশ্য অধিবাসে
ফলে, ছিন্নতার সূত্রেই ছিটকে পড়েছি মানচিত্র ছিঁড়ে
শূন্যতা বিভিন্ন রকম, মাথার উপরেও বিভিন্ন আকাশ...

যেটুকু অবশিষ্ট আমি, এখনো চোরাচোখে
মহিলা কলেজের দিকে, চলন্ত রিকশায়... এখানে ওখানে
কিংবা লিপিস্টিকের দোকানের সামনে দেখে যাচ্ছিলাম
মধুর উৎস! মধুবন্তী ছন্দে ফোট পুষ্প দি... ফুল আপুদের
মেঘ হলো, না বৃষ্টি হলো, হঠাৎ
এক কুঁড়ি, সতেরো পেরোইনি
সামান্য বাতাসেও সে এমন কম্পন তুলেছে ছবি এঁকে
শূন্যতা ঘোচানো শিল্পের শহরে
তাতে, ধাক্কা লাগছে দেহে;
দেহ তো একটা মনুমেন্ট, পরাক্রমী, মেঘ পর্যন্ত উঁচূ হতে গিয়ে
পাল্টা ধাক্কার চেতনায়, লোভে
ভেঙে-চুরে, খণ্ড-বিখণ্ড... দেহখানি
কত ছোট হয়ে ঢুকে যাচ্ছে, গলে পড়ছে আসন্ন ফুল-সম্ভবা
রেণু রেণু কুঁড়ির ভেতর...

আসিতেছে, চলিতেছে, পরবর্তী আকর্ষণ

আসিতেছে
দি নিউ কুয়াশা সার্কাস!
একটার পর একটা কেরা দেখতে হবে-
রোমান্টিক খেলা, হতবাক খেলা, ত্রিফলা, ত্রিফলা ছোরার নিচে শুয়ে-পড়া
মারাত্মক খেলা... হাই জোকার! হ্যালো রিংমাস্টার!!

বন্দি বাঘও খাঁচা থেকে বেরিয়ে ওস্তাদের চোখে চোখ রেখে খেলা দেখাবে
যদিও, সার্কাসে শিক্ষানবিশ বাঘের দুচোখে তখনও
ঘনজঙ্গলের স্মৃতি, বাঘিনীর জন্যে মায়া, প্রেম, পুনশ্চ শিকারের গুপ্ত সংকেত
খুব লক্ষ্য করে দেখলে, তোমার চোখেও ধরা পড়বে

চলিতেছে
আফটার দ্য রেইন!
কিন্তু সিনেমার শুরু থেকেই বৃষ্টি আর বৃষ্টি... শুধু বৃষ্টি?
এরকম কারেক্টারলেস বৃষ্টি কখনো আগে দেখা যায়নি;
যেহেতু রিয়েল রেইন, শট টু শট থার্টি ফাইভ ফ্রেমের বাইরেও
না-জানি কত প্রকার বৃষ্টি কত ভাবে ঝরিতেছে?
আনন্দ বেদনার বৃষ্টি, অত্যন্ত আবেগের বৃষ্টি, শুধু শুধু বৃষ্টি!
যাই হোক, আফটার দ্য রেইন কিভাবে দ্য এন্ড হবে
অনুমানেও কিছু বুঝতে পারছি না, কারণ
এই বৃষ্টি ক্যারেক্টারলেস বৃষ্টি, মনে হচ্ছে
এই বৃষ্টি আজীবন, কোনো তরুণের পক্ষেই থামানো সম্ভব হবে না
এই বৃষ্টি বুকের মধ্যে

পরবর্তী আকর্ষণ
নাটক!
অবশ্যই মঞ্চ খুব ছোট, কিন্তু এই ছোট মঞ্চের ওপরে বিদ্যুৎ বাল্বের
নিচে দাঁড়িয়ে
আমাকে বলতে হবে দীর্ঘ সংলাপ;
‘ওহ! কী বিস্তীর্ণ এই প্রায় মরে যাওয়া নদীবক্ষে শুধু বালি আর বালি
মাথার ওপরে একাদশীর চাঁদ
আমি এই চরাচরে পদচিহ্ন রেখে যাচ্ছি মিস দুষ্টু মেঘ উনিশের রজঃস্বলা মেঘ
একমাত্র তুমিই নষ্ট করতে পারো মিথ্যে মিথ্যে জোছনায়
জীবনব্যাপৃত এই বালিশিল্পকলা
কি, পারো না? বলো, বলো, বলো...

হাওয়া বিবিরা

হাওয়া, ভেন্টিলেটর হইতে...
ছাত্রী হলের বাথরুম
দূরে দাঁড়িয়ে
পাঁচিলের বাইরে থেকে ছুঁড়ে মারা ইটের টুকরো লেগে
ভেন্টির কাচ ভেঙে গেছে, ভেতরে বাল্ব জ্বলছে

ছাত্রী হলের বাথরুম থেকে ভেসে আসে স্নানরতা হাওয়া
আসে উস্কানিমূলক সুর
লিরিকটা উদ্দেশ্য প্রণোদিত
এদিকে, অনিদ্রারোগীর দরজায় টোকা মারে
রবীন্দ্র-বিষণ্ন গীতিকা

হাওয়া, ঝিরিঝিরি... হঠাৎ মত পাল্টিয়ে
ঝড়ো হয়ে উঠলে
একবার দেখা গেল
জামার তিনটা বোতামই নেই!

তরুণ কবির পায়ের নিচে কেঁপে কেঁপে ওঠে মিডনাইট
অ্যাসথেটিকস আত্মরতি করতে করতে আর্ট হয়ে ওঠে
পাতা কুড়োনিরা পাতা না কুড়োলে তো রান্নাই হবে না
বনপথ হারিয়ে যাবে
গাছ কখনোই বলবে না-
লোকালয় কোনদিকে, কতদূর?

হাওয়া, বাণ মারা হাওয়া, যথেষ্ট দুষ্টুও
পোশাক-আশাকে সে ভ্রূক্ষেপহীন, ভীষণ হেঁয়ালি
কোনোদিনও কবিতা পড়ে না- এমন প্রাণেও
কবিতা লেখার ভাব জমিয়ে দিচ্ছে

আমারও শরীর ভরা মনে এখন ব্যাপক সন্দেহ
চোত মাসের এই শেষ কয়টা দিনের হাওয়াই আড়ালে
বা অ-আড়ালে সব সর্বনাশ করে দিচ্ছে

কিন্তু হাওয়ার বিরুদ্ধে কে, কী বলবে?

চতুর্দশপদী নিয়তি-২

কোনদিন কোনো এক ঝোপঝাড় কুঞ্জের আড়ালে
আমরা ফড়িঙ ছিলাম, ওড়াউড়ি করেছিলাম,
মানবচক্ষুর কাছে পতঙ্গ ছিলাম; চক্রবালে
রূপ-পরিগ্রহে আজ আমি চড়ুই, ধর্মের বিধি কাম
আর তুমি বিবাহিতা, সন্ধ্যার বান্ধবী, তুমি রাধা
তুমি দারুবন থেকে প্রলুব্ধকরণী দ্রাক্ষা, চোলাই
তুমি টলোমলো জল চৈত্রাদিঘিতে দুর্জ্ঞেয় ধাঁধা

আমি ধার্মিক, ঝিনুকের বক্ষ খুলে দেখতেই চাই
যদিও তুমি আমার দুরপনেয় ফড়িঙবান্ধবী
উড্ডয়নের অনেক আগুন তোমার ডানায়, বুকে
উড়তে উড়তে আপেলবনে ঢুকে পড়েছি আমি

যখন মাছি ছিলাম, যেন মাছিই আপেলের স্বামী
শ্রাবণদিনের লিরিক্যাল মেঘ খরার সম্মুখে

তুমি বালিমাধুর্যের কবিতা... আমি বৃষ্টিফোঁটা, কবি

তীরের বালিতে লেখা

নদীটার কথা বলি না কাউকে
নদীটার নাম আকাশগঙ্গা
তীরে তীরে তার ছড়িয়েছিলাম
অপেক্ষমাণ মনের সংজ্ঞা

চাইনি কিংবা চেয়েছি বলেই
মন নিয়ে যায় মৎস্যগন্ধা
কেউ ছিল না, ঢেউ ছিল খুব
নদীতীরে যেই নামল সন্ধ্যা-

তারপর থেকে সন্ধি পাঠাই
মৎস্যগন্ধা করে না সন্ধি
তীরের বালিতে শুধু লেখা আছে
কে যেন কোথাও প্রতিদ্বন্দ্বি

Saturday, August 15, 2009

একটি ব্যক্তিগত কবিতা

আসো মুগ্ধপ্রবণ পাখি
আসো আনন্দগান, ঘরে
যাও নিজেকে দিয়ে ফাঁকি
যাও বীভৎস ঝাঁজ, ওড়ে

আসো আসা-মুহূর্তেই ঘোর
এসে দ্বিধার করাতে কাটো
আমার পথ্য আজও আদর
তুমি রুগীকে ফেলে হাঁটো

তুমি হাঁটতে হাঁটতে যাও
তুমি রিকশায় উঠে পড়ো
তুমি মন থেকে উধাও
তুমি ভুলেছ আমার ঘরও

ঘর বাইরে যেতে চায়
মাঠ বাইরে আনতে গিয়ে-
ভরা ভাদর, ভালোবাসায়
ভাবি মনে মনে মন-বিয়ে

মন শরীর সেঁচার সাধে
মন শরীর বলতে কানা
শরীর দোষী (!) অপরাধে
কেন মোম লাগানো ডানায়

আমি উড়তে চাওয়া খোকা?
দেখি তোমার ওড়াউড়ি?
মন কিশোর, চির বোকা
আমি বোকা মনে ঘুরি...

ঘরে-বাইরে কুয়াশা

আজকাল আর সাধুদের ভাত নেই!
সাধুরা খাচ্ছে ভাব, ভাবনার খেই।
কবে চলে গেছে সাধুভাষায় লিখিত কবিতার দিন!

এখন, অসাধু ভাষার রাতে, উপুড়ে হয়ে বিছানায় শুয়ে লিখি;
তার মানে আমি গৃহবন্দি, আমার লেখারা অন্তরীণ...

কিন্তু যদি কোনো কুয়াশা-স্টেশনে বসে, এত রাতে
বহুদূর থেকে ছুটে আসা অনাগত এক ট্রেনকে মাথায় রেখে
অপেক্ষায় সংজ্ঘা লিখতাম-
তখন কি রেললাইন সেই সংজ্ঞা মুখস্থ করত না?

যদি দিনাজপুর-বড়মাঠ পেরিয়ে মিশনারি পল্লির পাশ ঘেঁষে
চলে যাওয়া কাঁচাপাকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি লিখতাম
একদিন ফেলে আসা মফস্বল বৃত্তান্ত:
-এ জীবন বড়ই নচ্ছার... চাঁদ তোমাকে সাক্ষি পুরস্কার...
তবে কি সে- বৃত্তান্তের কয়েকপৃষ্ঠা পড়তে পারত
অবকাশে চৌধুরী বংশের মেয়ে, তাজমহল রোডের?

প্রতিদিন বাইরে যাই নাকি বাইরে থেকে ফিরি ঘরে?
এই প্রশ্ন মাথা কুটে মরে-
যেহেতু ঘরের মধ্যে লিখি রুম, বাথরুম, বই, বুকশেলফ
জানলার পর্দা, টিভি, টেলিফোন;
বাইরে বাগদত্তা সম্ভাবনা, বাইরে অঘ্রাণ, হরিণের ডাক
বাইরে হেমন্ত, থৈ থৈ কুয়াশা
কুরঙ্গগঞ্জন...

শাদা কবিতা

এবার, লিখে রাখছি বনভূমি, অথচ লোকালয়ে
আমার কোনো শেকড়ও নেই, ডানাও নেই- পাখি
লিখে রাখছি দু-একটা দিন রৌদ্রবিহীন... দূরে
আমি যে এই বাড়িতে থাকি- বাড়িটা ভবঘুরে...

এবার, এঁকে রাখছি উলুখড় ও চৈত্রপাড়ের হাওয়া
রইল আরো হাড়ের মজুদ ঠা ঠা কাঠের প্রতিভা
এঁকে রাখছি আসন্ন রাত বা উন্মাদ গলি
গলির শেষে গল্প একা, সে যায় শহরতলি...

এবার, লিখে রাখছি ভ্রমাত্মকের দগ্ধ ইতিহাস
স্থানীয় আকাশ অমর দিনাজপুরের মাঠে-
মৃতজোছনা পড়ে আছে ছিয়ানব্বই সালে
তাই লিখি এই টেবিলে মানে বৃক্ষের কঙ্কালে...

আর লেখা সেই শাদা কাগজ হাওয়াতে যায় উড়ে
আমি যে এই বাড়িতে থাকি- বাড়িটা ভবঘুরে...

বর্ষায় পুলিশশ্রেণী

বৃষ্টিতে ভেজার আগেই, পুলিশ ধরেছে, এই বর্ষায়

‘নীলক্ষেত’ এই সংকেতময়-বিভোরতা থেকে এদিকে ফিরছিলাম।
‘কাঁটাবন’ বেশ কথাবন হয়ে ওঠে- ভাবছিলাম
মাছবন্দি অ্যাকুরিয়াম, পাখিবন্দি খাঁচা, বিদেশি কুকুরের বাচ্চা, ফুলগুচ্ছ
আর ‘বৃষ্টি হবে হবে’ ভাবে আমি তোমাকেও ভাবছিলাম, তখনই

পুলিশ! পুলিশ আমাকে চেক করে, সন্ধান করে দ্যাখে-
আমার মধ্যে আমি অবৈধ কি কি পকেটে নিয়েছি?
সুযোগে পুলিশ আমার পাছায় ও শিশ্নে হাত দেয়, একসময়
বৃষ্টি নামার আগেই, বেশকিছু বাক্য খরচপূর্বক, পুলিশ হইতে পরিত্রাণ পাই
আমি দ্রুত উৎকণ্ঠিত, নিকটের সেলুনঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ি,
আমার আর বৃষ্টিতে ভেজা হয় না...
যদিও বরষা যায়, ঝরো ঝরো হায়
শুকনো পাঠক কভু ভেজে না কবিতায়

আয়নায় আমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চেপে যাই
পুলিশ আমার চোখ দেখে তো কাঁচকলাও টের পায়নি;
আইনসম্মত নয় এমন কত কী আমি পথে পথে, জানালায়
দেখে এলাম।
আমার চোখের মধ্যে যে অসীম... বাস করছে সে তো
এই রাস্ট্র-ধারণার উপরে হাগে প্রতিদিন।
সে তো আজও তোমাকে চায়, অথচ তুমি
তোমাদের ভাষায় কখনও বৈধ কি?
অবশ্য আমার সামনে দাঁড়ালে, তুমি দেখতে পেতে সেই ডানা, সেই পাখি
কিন্তু পুলিশ দ্যাখেনি, পুলিশ তো কোনওদিন পাখি ওড়াও দ্যাখেনি

আহারে, এবার বৃষ্টিতে ভিজব, ইচ্ছা ছিল।
আমি বৃষ্টিতে ভিজতে পারিনি, নির্বিঘ্নে আমি তোমাকে ভাবতে পারিনি
পুলিশ ধরেছে বলে
যদিও বরষা যায়, হায় কলা-কৌশলে
আমাকে বৃষ্টিবঞ্চিত, খা খা রাখা হল, পুলিশ-অ্যাক্ট সিস্টেমে

আমাদের পুলিশ পাখি দ্যাখে না, বৃষ্টি বোঝে না, পড়ে না কখনও প্রেমে!

বলাকা সিনেমা হল

মহাকালের মাত্র দেড় দুই ঘণ্টা সম্পূর্ণ রঙিন-
এই সত্য দেখেছি বলাকা সিনেমা হলে বসে, আমরা দুজন।
ইভেনিং শো’র আগে-পরের ইতিহাস ধুধু-শাদাকালো ফুটেজে
পূর্ণদৈর্ঘ্য বাঙালি জীবন!
একুশ শতকের হাওয়ার মধ্যেও এসে পৌঁছুল হুহু!
ভাটিয়ালিভরা রাখালি জীবন!

এই মধ্যেও শিখে ফেলি বনময়ূরের নাচ, বুনোফুলের গান
আয়নার সামনে রূপ-ম্যাটাডোর, নিশ্চিত বিয়োগান্তক লড়াই
এই বুঝি আমাদের অভিনীত প্রেম?
পাণ্ডুলিপি যথেষ্ট ধূসর কিন্তু সংলাপ এখনো জীবন্ত-
এটাই বঙ্গের ক্লাসিক্যাল প্রবলেম...

আর সেই ইভিনিং শো’র পরে
আমরাও আর পর্দায় নেই, সেই সুযোগে
কত নব নব ছবি, নতুন নতুন জুটি শুভমুক্তি পাচ্ছে, পাবেই তো।
শুনেছি, সাম্প্রতিক লাভ স্টোরিগুলো নাকি প্রথম সপ্তায়
মোটে তিনদিন চলে?
কী স্বপ্নাচ্ছন্ন, প্রসন্ন পাহাড়ি বৃষ্টি ও মেঘে, শো চলাকালীন
সম্পূর্ণ রঙিন দেড়-দুই ঘণ্টার অন্ধকারই চূড়ান্ত সত্য, পাশাপাশি
নিঃশ্বাসেরও একটা বিপ্লবী ভূমিকা অনস্বীকার্য
নৈঃশব্দে, পাখি আমার পাশে আমি পাখি দেখছিলাম
বলাকা সিনেমা হলে...

জঙ্গলের মধ্যে জাদুঘর

জঙ্গল দেখলেই মনে হয়, ঐ জঙ্গলের একদম ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। অসংখ্য গাছে গাছে ভরা অবিরাম পাতায় পাতায় হাওয়া-বাতাসের অর্কেস্ট্রা আর অগণন পাখিতে পাখিতে নরম পালকে পালকে ডিসপ্লে করা গ্রিনমিউজিয়াম... এই পৃথিবীতে যতগুলো জঙ্গল আছে, প্রায় প্রত্যেকটা জঙ্গলের মধ্যেই একটা করে জাদুঘর আছে

জাদুঘরে, গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছে মরচেধরা অনেকদিন আগের একটা বাইসাইকেল। সেই সাইকেলটা কার গো, কার? যথা অপরিণামদর্শি কৌতূহলে, জঙ্গলে প্রবেশ করিয়া যে বালক আর কোনদিন ফিরে আসিল না, তার? জংলিপনায় স্নাতকোত্তর আমি, জঙ্গল দেখলেই বুঝতে পারি- এই জঙ্গলের ভেতরে একটা জাদুঘর আছে। বাইসাইকেল আছে। বালক-পুরুষ ফিরতে না-পারার জনশ্রুতি আছে।

জনশ্রুতির অধিক রহস্য, সেটাই ধরিত্রী, অবলীলা চৌধুরীর লাবণ্য; লাবণ্যের ভেতরে মিশিমিশি আফ্রিকা, ঘনান্ধকার আমাজান... সাহস করে একবার ঢুকে পড়লেই জাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাবার প্রেরণা পাওয়া যাবে। ক্লান্ত সাইকেল গাছে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে এবং সম্ভবত আমার আর কোনওদিন ফিরে আসা হবে না... হবে না

এ অঞ্চলে এটাই সত্য, জঙ্গলে হারানো পুরুষ শেষপর্যন্ত কিংবদন্তি হয়ে যায়।

আশ্চর্যসমগ্র ষোলো লাইন

এখনো ঝুমঝুমপুর নামে মাত্র, আদতে স্তব্ধ, নিম্নবিত্ত রেলস্টেশন
ক্রস করে যায় বনেদি আন্তঃনগর, তার দাঁড়াবার কথা নয়
So, এখনো পাহাড়ি পথে শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রশ্ন, যুগপৎ হাঁটুর ক্ষমতা-
এখনো বস্তির শিশুর বাবা আড়াই বিয়ের পর এলাকা ছাড়া...

এখনো কবিতা মানে ভাব-ছন্দ-মাত্রা, মনোময়ী প্রত্নতাত্ত্বিক
নবগঙ্গা নদীর দুধারে রোদ পোহাচ্ছে বেলে শীতকাল
মাঠতক পর্যাপ্ত হলুদ প্রফুল্ল, শহরে প্রেসমেশিনের মায়া
ঘুরে ফিরে আসে নবদিগন্তের অজ্ঞাত-ব্যঞ্জন, শ্রীমতী কুয়াশা

পিপাসায় কমলালেবুর কথাই ফার্স্ট চান্সে ঠোঁটের বিকল্প
এখনো রাস্তার কোনো পাগলির পারিবারিক নাম জানা হলো না
এবং টমেটো বলতে দৌলতদিয়া ঘাটের একপলক টসটসে কিশোরী
এখনো শীতের পরে বসন্ত আসে, নদী ওড়ে, প্রেম সম্পূর্ণ অবৈতনিক

এখনো একটি মেয়ে, আমাকেও না জনিয়ে আত্মহত্যায় চূড়ান্ত প্রস্তুত
,, ক-এর পরে খ. গ. ঘ. ঙ... নীলুর বড়পা’র বিয়ে হচ্ছে না
,, বিস্ময় বেঁচে আছে, তবে তার স্টারভ্যালু কমেছে একটু
,, রাস্তার শেষ বাড়ি একটা গল্প, বাথরুম থেকে ঝর্ণার গান
ভেসে আসে...

Thursday, August 13, 2009

অন্তর্লক্ষের কবিতা

শীতের রচনা আমি কী লিখব?

চাকরি করি ভাবসম্প্রচার কেন্দ্রে
ভাব কত প্রকার ও কি কি? হয়তো শীতকাল
আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নয়-

আমার মধ্যে খানিকটা গ্রীষ্মাতিগ্রীষ্ম, দগ্ধঋতুকা
আর বীজপত্রে নিহিত বৃক্ষের ডালপালা আর ছায়ার মতো
অনাগত এক বসন্ত-সংকেত যে আছে, তা প্রমাণিত
এবং তা প্রভাবিত... মৌসুম-তাড়িত!

তবু শীতের ওয়াশ আমি কী ছাপাবো?

আমার চেয়ে পাঁচশ বর্গ বেশিজানে কুয়াশা-
কুয়াশাই আমার চেয়ে মোটের উপর বেশি জানে
শীত কেন আসে? শীতের ভাবার্থ কি? শীত কাকে বলে?

শীত সম্পর্কে কুয়াশাদের এত বেশি আগ্রহ, এত বেশি কৌতূহল
বরং কুয়াশাই লিখুক শীত-শীত-শীতায়ন;
আমি বড়জোড় কুয়াশার দিকে খেয়াল রাখব,
আরেকটু ঘনত্ব দেখলেই আমি হয়তো
সদানন্দে ঢুকে পড়ব কুয়াশা ভবনে;

একই সঙ্গে জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত এই শীতে
হয়তো কিছুটা কুয়াশা হয়েই থাকব
ভোরে, দূরের সন্ধ্যায়, আঁধারস্য রাত্রিপথে-

এই লক্ষে লেখালেখি করি, থাকি ভাবনাজগতে

দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস

আয়নার মধ্যে তাকিয়ে নিজেকে রাক্ষস মনে হলো!

সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসের মানে, সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিদানে পাওয়া গেল- নরখাদক জাতি, নিশাচর, কর্বূর, প্রাচীন অনার্যজাতি ইত্যাদি... যদিও, রাক্ষসের একটা অপ্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি আঁকা আছে মনুষ্যকুলের মনে। এটা জানি, কারণ এদ্দিন আমিও মানুষের রোল প্লে করে এসেছি। এদ্দিন আমিও মানুষ ছিলাম।

কিন্তু আজ! আজই, নাকি কয়েকদিন ধরেই, যখনই আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দাঁড়াই, বিলিভ ইট, আমার চোখেই ধরা পড়ে আমি একটা রাক্ষস! আমার সারামুখে ডাইনিদের মিহি-নিঃশ্বাসের আঁচে পৃথিবী দেখার মায়াময় ম্যাপ আঁকা হয়ে চলেছে, মুখ বিভাজিত হয়ে পড়েছে...

বিশেষ দ্রষ্টব্য ১. ডাইনিদের একেকটি নিঃশ্বাস কমপক্ষে বারোমাস মাথার মধ্যে কিংবা দেওয়ালে ঝুলে থাকে; তারপর আরেকটি নিঃশ্বাসে ছাপা হয় আবার একটি বাৎসরিক ক্যালেন্ডার

বিশেষ দ্রষ্টব্য ২. ডাইনিদের নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে অনেক তরুণ যোদ্ধা অকালেই মরে ভূত হয়ে যায়। যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, আমার মতোন, একদিন আয়নার মধ্যে তাকিয়ে দ্যাখে সে নরখাদক, সুযোগ পেয়ে নিজেকে খেয়েছে; সে নিশাচর, আঁখিতে আঁধি চারণ করেছে; সে প্রাচীন অনার্য, কারণ তার অনুচ্চবর্গের দেহ;

দেখি, আয়নার মধ্যে আনস্পেকটেড একটি অচেনা মুখ, রাক্ষসের

কুয়াশায় রচিত একটি রাতের কবিতা

স্বেচ্চায় হারিয়ে গেলে, জঙ্গল ডাকনাম ধরে ডাকে!
আর তখনই ঘোর বাল্যকাল, অভিমান-ভরা কবিতা হয়ে ওঠে!
কিন্তু দার্ঢ্যপাঠকের মন, তুড়িদিয়ে উড়িয়ে দিতে চায়-
রিপিটেশন... সব রিপিটেশন

শুনেছি, হারানো বালকেরা জঙ্গলে গিয়ে গাছ হয়ে যায়।
সেই গাছ একদিন কাঠ হয়ে ফিরে আসে যে অমনযোগী
ছাত্রের টেবিলে সে কবিজন্ম পায়!
এতদসঙ্গে- খিদে লাগলে খুঁটে খাওয়া শস্যদানা কবুতরের ঠোঁটে ছড়ায়
বাকবাকুম ছন্দে উৎসাহে;
মেলে না, তবু কী মেলে, হারিয়ে গেলে, ফুটে ওঠে এক বুদ্বুদপ্রশ্ন-
কী চাহ কী চাহ?
চাই আমি যা- আমার কবিতা কোনো প্রেসমেশিনে ছাপা না হলেও
হেমন্তপীড়িত গাছে গাছে, প্রতিটি পাতায় ছাপা হোক অ্যালিগরি
ঋতুর কুয়াশা মেখ অফসেট জ্যোৎস্নায়!
শীতে সেই কবিতাপাতারা ঝরতে ঝরতে দূরে, উড়ে যাক;
বিষণ্নতাস্পৃষ্ট রাতে
বিছানায় শুয়ে শুয়ে, ঘুম-অনাগত কালে
অস্ফূট-বেদনাসহ যেমন একটি গোপন শ্বাস গোপনেই
বাতাসে মিলিয়ে যায়

বসন্তবায়ুর চাপে লেখা কবিতা

ওগো বায়ু-বিধি-বধূ মহুয়া ফুলের মধু
চলো পান করে মরে যাই
কেন মরে যাব, বলি; দু’একটা গানের কলি
তিন পেগ রব সমান, ধরে যায়

দু’একটা গানের সুরে সে কার নূপুরে-ঘুঙুরে
ভাঙা রাজবাড়ি হেঁটে যায়
শব্দ-বাক্য তারই ছলা সদানন্দ কাব্যকলা
প্রেসের সুবিধাপ্রাপ্ত- লিখে যাই

প্রেমের বয়ান গাঢ় আরো আরো আরো আরো
নিজে না টিকলেও, প্রেম যেন টিকে যায়

প্রেমছাড়া চলতে পারে? ভব জগৎসংসারে
পিঁপড়াও জুটি জুটি, একা নেই
চঞ্চল মামুন, আমি ‘বিবেকানন্দ’ -স্বামী
ভগিনী (!) নিবেদিতা’রও দেখা নেই!!

সুপারসনিক ইগো

মাঠ যদি মহাজাগতিক, অ্যালকোহলিক চাঁদ-
চাঁদের বয়ান থাক, দেখি, নিউ কুয়াশা অপেরা...
এই সন্ধ্যা মনোজাগতিক, শোনো অন্তিম প্রবাদ-
সড়কেরও মনে নেই কোনো গল্প জানে কিনা, ফেরার?

কোথাও বংশীর রাত, হুহুমিশ্র হিঙুল বাতাস
কোথাও বস্তিতে সুরময় নবজাতকের ক্ষুধা;
কোথাও অন্ধ খুঁজছে কোনদিকে পুবের আকাশ-
কোথাও অমল ঘুমায়, এদ্দিনে ভুলে গেছে সুধা?

শুধু আগুন ভোলেনি খড়, পিপাসা ভোলেনি ঠোঁট
শুধু প্রত্যাশা ভোলেনি তরু, পিঞ্জর ভোলেনি চাওয়া
শুধু প্রান্তিক ভোলেনি কেন্দ্র, মধ্যে সমাজ, সংকট
শুধু দুই পা ভোলেনি ধর্ম, তীর্থের দিকে যাওয়া

আমার দুচোখ যাকে লুটে পেতে চায়; দূর থেকে
বহে ইগো, সুপারসনিক, অন্য কে বুঝবে দেখে?

বড়ঋতুর কবিতা

ছোট ছোট ঋতু এসে ঘর ভরে গেল
জানালা-দরোজা খুলে, ভেতরে-বাইরে
ছোট ছোট ঋতু এসে ঋতুশিক্ষা দিল;
আমি ছোটঋতুদের সঙ্গেই বড় হয়ে উঠতে উঠতে

একদিন, এক দ্রবীভূত-সন্ধ্যায়
আমার মধ্যে এসে মিশে যায় যুগচর্চার
এক উত্তর-আধুনিক ঋতুর ধারণা
দেখি, দুমাস যেতে না যেতেই ঋতু তার যথার্থ হারায়
ফিরে আসে অন্য এক ঋতু, নবাগতা
ফলে, উড়নচণ্ডি কোনও অশিষ্ট হাওয়ায়, যথা
ভাবে ও অভাবে
এই যে এত এত ঋতু এসে ঘর ভরে থাকে;
এরই মধ্যে একদিন, ঝিমুনো-দুপুরে হঠাৎ, ঝাঁপি খুলে হাতড়ে দেখি
তেষ্টাক্লান্ত গ্রীষ্মকাল কখন যে চলে গেছে পহেলা আষাঢ়ে;

কত কী দেখা যায়, রীতিনীতি ভঙ্গ হচ্ছে: শ্রাবণ ও ভাদর
একটানা ভিজে চলেছে... বর্ষা তার মেঘাস্ত্র ক্ষমতার লোভে
শরতের মধ্যে ঢুকে পড়ছে...

ফাঁকে, এক অজ্ঞাত অপরাহ্নে, হলুদ হেমন্ত চলে গেছে ভুয়াফাল্গুনের দিকে
ফলে, বসন্ত বিলিয়ে যাওয়া ভবদীয়া শিহরণ-
পূর্বক, কতদিন আমি করে করে যাব ষড়ঋতুর রূপায়ণ?
আমার চোখ দেখে তো আয়না বলছে (আয়না জ্যোতিষী?) আমি নাকি
লীলাময়ী ঋতুর কবলে পড়ে মরে যাব একদিন
আশ্বিনে নয় ফাল্গুনে নয়... তবে?

কিন্তু ইতিমধ্যেই আমি অনেক গোধূলি, ভাঙারাস্তা, ভূমিকম্পিত
কূটনীতি, রাস্ট্রসংঘ, স্নায়ুযুদ্ধ
হত্যাস্বপ্ন, অগণন আত্মরতি, তীরের ফলার মতো ছুটে যাওয়া ক্রোধ
আর
নিসর্দ-আশ্রিত ষড়ঋতু পেরিয়ে, বেরিয়ে পড়েছি
তোফা, এক বড়ঋতুর সন্ধানে...

বড়ঋতু বলতে, ভুবনীকরণ ক্রীড়াঙ্গনের অনেক দূরের
তারাউজালার গ্রামের হাটে হেঁটে যাওয়া
ঝাঁকা মাথায় সূর্যাস্ত

বড়ঋতু বলতে, যে ঋতুর মধ্যে বসে পরস্ত্রীর সঙ্গলাভের আশায়
আততায়ী হওয়া যায়?
বড়ঋতু বলতে, যে ঋতুর মধ্যে অভাব্য বিনাশ লুকিয়ে থাকে?
বড়ঋতু বলতে, যে ঋতুর মহিমা নিয়ে ইতিপূর্বে বক্তব্য ছিল না।

কিন্তু আমাকে বলতে হচ্ছে... বড়ঋতুতে আমি ফের অভিশপ্ত, আহত
নাভির ছায়ায় ঘুমোব কিনা?
বড়ঋতুতে আমি উন্মাদ, ছুরি হাতে ছুটে যাব দিগন্তের দিকে?
নাকি, সব ঋষ্যসম্ভাবনা এক ফুঁ-এ নিভিয়ে দিয়ে
আমি হয়ে যাব গেরুয়া ধর্মের অপার, পাড়-উপাসক?

ছোট ছোট ঋতু আমি মনে রাখব না
ছোট ছোট ঋতু আনে সাময়িক সংকল্প
ছোট ছোট ঋতু মানে এককাপ ‘রং চা’ দুটো টিউশনি-বিস্কুট
ছোট ছোট ঋতু জানে দ্বন্দে দুজনেই উত্তীর্ণ, দুজনেই একা একা যৌথবন্দি

যদিও, আমি এক তোফা বড়ঋতুর সন্ধানে নিসর্গসম্মত
ডাহা আহ্লাদ পেরিয়ে বেরিয়ে পড়েছি
দেখি, তোমার কাছে তাহা মেলে কিনা?
যদি মেলে, রাত তিনটেয়ও আমি ঘণ্টা বাজিয়ে জানিয়ে দেব
ঋতুমৃত্যু নিশ্চিত আমার
এবং এখন এমন একটি সময়
যখন, মধুমাসে বৃষ্টি এলো, রোম্যান্টিক... পাঁজা কোলো করে ধরা বৃষ্টি
মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টিতে একমাত্র তুমিই ঋতুমতী, ঋতুমতী

চাইল্ডহুড মেমোরি

অনেকটা মনে নেই, অনেকটা মনে আছে
শুরুতেই গাঙের গল্প: হাফপ্যান্ট ডাঙায় খুলে রেখে, বিরাট একটা দৌড়ের ভাব বাগায়ে তীর থেকে ঝাঁপায়ে পড়া গাঙটাকে বর্ষাকালে কত বড় নদ মনে হত। আর আমাদের ইশকুলের মাঠকেই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মাঠ বলে মনে হত। আমাদের ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডেই মনে হতো সবচেয়ে বেশি চকের অঙ্ক, চকের কবিতা লেখা হয়েছিল। রাশি রাশি প্রশ্নোত্তর লেখা সেই চকের অত্যাচারে ব্ল্যাকবোর্ড প্রায় শাদা হয়ে গেল। ওয়াপদা হচ্ছে আমাদের প্রথম দেখা সবচেয়ে বড় অফিস- রুপালির বাবা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অফিসার। ক্লাস টুতে ঊর্মিকে দেখার পর, ফোর-এ উঠেই আমি রুপালিকে পেয়ে গেলাম। এর চেয়ে বড় ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে বলে আজ আর মনে পড়ে না

আমাদের ইংরেজির জাহাজ বিনোদ স্যার, কুদ্দুস স্যার অঙ্কের। মানুষের মধ্যে দেখা সেই জাহাজের পাটাতেই ছিল সবচেয়ে বড়। আর আমাদের ইশকুলের দফতরির ঘরের সামনে সেই যে দুজনা: কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়া... সঙ্গত কারণেই আকাশ ভরে এতো-ম্যাতো রঙ আর ফুল আর কোথাও ফুটতে দেখিনি

তারপর, নাইনে উঠেই রুবিপা পালিয়ে গেল। এ রকম দুর্যোগের ঘটনা শুনে আমারই খুব কষ্ট হচ্ছিল, গোপনে ভীষণ কান্দা আসতিছিল। যদিও আমি নিচের ক্লাস, আমি ক্লাস এইট...

এরপর একদিন আমাদের কমনরুমে কোত্থেকে এক জাদুকর এসে খেলা দেখাচ্ছিল। অপার মুগ্ধতায়, কপারফিল্ডের নাম শোনার আগেই আমরা সেই পৃথিবীর সেরা জাদুকরকে আমাদের ইশকুলে দেখে ফেলি। আহা সেই রাত জেগে ভিসিআরে চুপিচুপি নীল ছবি দেখার সময়, সে সময়ই আমাদের টেলিভিশন মনিটর ও বাস্তবতা পার্থক্য ধরার যুগ... হুমায়ুনের সাইকেল ছিল হুমায়ুনের চেয়ে উঁচূ আর জুতোর ভেতরে আমার পা-জোড়া দিনদিন বড় হয়ে যাচ্ছিল... আ-হা-রে...

অনেকটা মনে আছে অনেকটা মনে নেই সেইসব বড় বড় ব্যাপার, আজ তাকে ছোট মনে হয়?

অমরত্ব, দুঃখবোধ

অমরত্ব পেতে পারে গৌতম বুদ্ধের জীবনী
আর আমার বর্ণাঢ্য বাল্যকাল, বয়ঃসন্ধির অবদমন

ইশকুলের ব্ল্যাকবোর্ডে লিখতে গিয়ে উড়ে যাওয়া
শাদা শাদা চকের গুঁড়োয়
আমিও উড়ে উড়ে যতবার পাহাড়ে যাই, দেখি
একটি কিশোর ফড়িঙ আর একটি কিশোরী প্রজাপতি
বসে আছে নীলমেঘে, চূড়োয়
তারা আর নামতে চায় না, তারা নামতে পারে না
শুধু একটি আদুরে ঝরনা নাচতে নাচতে এসে কথা বলে
ছন্দে ছন্দে, টুবটাব ভাষায় কথা বলে অন্তরঙ্গ জলে
যে ভাষায় প্ররোচনা-লিপ্ত কিশোর-কিশোরীর
পালিয়ে থাকার মুহূর্তগুলো
সেও তো অমর, দুচোখ ভরে স্বপ্ন আঁকা
পাড়া-প্রতিবেশী, পাড়ার মোড়ের উল্টোদিকের
বাড়ির ছাদে, চিলেকোঠায়
তাকিয়ে থেকেই বয়ঃসন্ধি অমরত্বের সাধে
এখনো নাকি তাকিয়ে আছে সেই বয়সটা রাতের দিকে
সাপোর্ট পাচ্ছে চাঁদের

একচুয়ালি, যার যেদিকে ইচ্ছা, সেদিকে সে যাবেই
আর যদি গৌতম বুদ্ধ টিকে থাকে, তো টিকে থাকবে আমার
অমর বাল্যকাল, অবদমনের আন্ধি-গুন্দি, বয়ঃসন্ধির উড়নচণ্ডি

অপাপবিদ্ধ একদিন, নিখিল যৌবনও উজাড় করে দিয়ে যাব।
মাঝেমধ্যে ভাবি, কেউ পাবে-
তার জন্য দুঃখ পাই, যে না পাবে।

Wednesday, August 12, 2009

পরিস্থিতি

শুভার্থী সন্ধ্যার সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি মাঝেমধ্যে বলে
আমার গল্পগুলো দুই পঙক্তি পার না হতেই
দুর্দান্ত কবিতা হয়ে ওঠে!
আমি কী করব? যদি দেখি
আড্ডা ভেঙে ফেরার সময় মাঝরাতে
আমার দুচোখে ফোটে পাথরের ফুল
আমি ঘরে ফিরতে পারি না আর, পথ ভুলে যাই
তাছাড়া বুঝতে পারি সকল কিছুতে থেকেও তবু আমি
কিছুতে নাই
তাহলে ফুলের মধ্যে, ভুলের মধ্যেও কেন
ডাকি, ভুল, আয় খুকু আয়

ঝড় তো পরের কথা পাঠকের সামান্য নিঃশ্বাসেই
আমার গল্পগুলো ভেঙে ভেঙে পড়ে।
গল্পের টুকরোগুলো কার্পাসচিত্রের ধর্মে উড়ে যেতে যেতে
আরো কিছু স্থিতি চায়, সে যায় মেঘের কাছে
গল্প বলে, সে গল্পের নাম ‘নিঃসঙ্গতা’
শুভার্থী সন্ধ্যার মেঘ, তাদেরও উষ্মা আছে, তারাও বলেন
‘তুমি খুব বেশি লেখো, কাগজ খুললেই দেখি
তোমার অজস্র লেখালেখি।’
আমার ভ্রূক্ষেপ হয় না, হয় না বিব্রতবোধ, বিস্ময়ও লাগে না,
কারণ আমি তো জানি, রৌদ্রের প্রতিটি মুহূর্তে আমি লিখে যেতে চাই
হারাগাছ থেকে দূর হাভানা অবধি যত তামাকভূমির
অতিশয় গনগনে আগুন
তাদের শিখার কাছে নিজেকে বানাব খড়,
মেলে ধরব আমাকেই আমি,
লিখে দেবো, আগুনের রক্তহলুদ ওই শিখার ভেতরে
যেসব সবুজ-নীল দৃশ্যকল্প হয়
তাদের ভেতরে আমি নিজ আত্মপ্রতিকৃতি চিত্রিত দেখেছি

ঘুমের মধ্যেও আমি লিখে গেছি রাশি রাশি চাপ চাপ
আঁধারকাহিনী
কহিনী বলাতে আজ মনে পড়ল, বন্ধুদেরও জানা নেই
বুনো ওই মেঘগুলো সশস্ত্র রেজিমেন্ট, আমার বাহিনী

দিনে, দুপুরের দিকে- পুরো এই দুপুরই আমার-
দিগন্তে মাঠের মধ্যে যতগুলো হাওয়ার খামার
সব লিখে পাওয়া চাই!
তা তো লিখে যাব, ভেবে তাকিয়ে দেখেছি
আকাশে অনেক তারা, একটিও তার মতো নাই

বাতাসে ভাসছে গীতি, গীতি কী রে, পোড়া গন্ধ!
পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমার সন্তান, কবিতাই...

কবিতা ২০০৭

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে, বহু আকাক্সিক্ষত সঙ্গমও ব্যর্থ হয়ে যায়। একটি ব্যর্থ শিশুর কান্নায় যতখানি অসহায়ত্ব ধ্বনিত হয়, দেশের সঙ্গীতশিল্প তার চেয়ে তিনগুণ দুঃখবাদী হয়ে ওঠে। সিডি ভর্তি হাহাকার, প্রচারে স্বয়ং হাওয়া। তাহলে কবিতার অবস্থা কি? ভাইরে, সে তো এক প্রায় শুকনো নদীর পাড়ে তারাউজালা বালক বিদ্যালয়... সে আর ইশকুল পালানো দিন অতিক্রম করতে পারে না- এই-ই তার স্বভাব। স্বভাবের বাবার নাম চিরকাল; ফলে কবিতা চাকরি করে বাঁচে বিজ্ঞ-আপন অফিসে, পদবি ক্রিয়েটিভ রাইটার।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে, সঙ্গমও ব্যর্থ হতে বাধ্য। ছবি আঁকা মাল, বড্ড বেসামাল। বিদেশি বণিকের জাহাজে রঙিন আলকাতরা মাখানো আর্টওয়ার্ক সে দিব্যি চালিয়ে যেতে পারে। হয়তো পারে না। সেই না-পারা মালকে দীর্ঘদিন আমাদের মনে পড়ে না।

তবে, নাটক জমে ওঠে। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে নাটক জমতে বাধ্য। কেউ কেউ নিজের চরিত্র ডিঙিয়ে বিশেষ কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেই। ঐতিহাসিক দৃশ্যপটও খুব কাছে থেকে, ক্লোজআপে দেখা যায়। লংশটে সংলাপ শোনা যায়। অগণন মানুষ, ভেড়ার পালের মতোন মানুষ তখন অডিয়েন্স হয়ে পড়ে।

সফল অভ্যুত্থান সফল সঙ্গম একসূত্রে শৈলীগ্রন্তে গাথা। আজ, এখন, এ মুহূর্তেও কেবল অভ্যুত্থানের পক্ষে দাঁড়ালেই একটি সফল সঙ্গমের স্মৃতি আমরা অর্জন করতে পারব। দিন বদলে যাবে। রাতও চেঞ্জ লাগবে। আসিবে ভালোবাসিবার মতো সেইসব দিন, কৃষ্ণচূড়ার রাস্তাওয়ালা দিন, কিংবা নতুন ভাবীর ব্লাউজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাত, ফুটফুটে অন্ধকার...

সফল অভ্যুত্থানের জন্য, সফল সঙ্গমের জন্য আমাদের কি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে? রাতগুলোকে বিসর্জন দিতে হবে?

কুয়াশা সিরিজ : ৩১

জুলেখা বাদশার মেয়ে। তাহার ভারি অহংকার...

গল্পের, এইটুকু মনে পড়ে। এরপর, গ্রামাচ্ছন্ন সাধারণ ছোটবেলা ছেড়ে, দিগন্ত প্রদেশে আঁকা এক শরণার্থী শিবিরের পথে বেরিয়ে পড়েছি! আচম্বিতে গোলাগুলির শব্দ আর আকাশ থেকে বোমা পড়ার আর্তনাদ শুনে, বুঝেছি- ধারেকাছে কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে! হঠাৎ থামতে হল, আরেক পা সামনেই কি পুঁতে রাখা ভূমিমাইন? অতিসন্তর্পণে, শরণার্থী শিবিরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে আমি হেঁটেই চলেছি...

পথে, যত দিনান্তের প্রস্থানপ্রিয় সূর্যাস্তের রক্তিম প্লাকার্ডে জ্বলে ওঠে পশ্চিমের ট্রাফিক সিগন্যাল, যদিও গোপনে সব সময় আইন অমান্য করেই স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সন্ধ্যার কুয়াশামালা মারাত্মক বিভ্রকারিণী, সঙ্গে প্রতিবেশিদের মতো অন্ধকার; কোথাও বসলেই অন্ধকারকে মনে হয় বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তন! যেন, এক্ষুণি শুরু হবে শীতের দেশের অনূদিত এক ব্যালেপ্রধান নাটক, এই নাটকের উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য মঞ্চ থাকে মাথার উপরে, যেখানে আকাশ... নক্ষত্রের চরিত্রে নক্ষত্রেরাই পারফর্ম করে কিন্তু চাঁদের চরিত্রে জেগে থাকে দূরে দেখে চেনা-চেনা-প্রিয় যদিও তেমন কথা না-হওয়া এমন একটি মেয়ে, আর এই নৈঃশব্দপীড়িত দৃশ্যের নিচে আমিই একচ্ছত্র অডিয়েন্স! মুগ্ধতায় আকুল দর্শক। মিডিয়া জানে না- শিল্পকলায় প্রতিভাবান নেশাদগ্ধ তরুণ... কিন্তু আমি জানি, অন্ধকারের শীতরাত্রি আমারই উদ্দেশ্যে রচিত...

তাহলে, চাঁদের চরিত্রে রূপদান করছে কে? কুয়াশা? কুয়াশাও চৌধুরীল মেয়ে! তাহার ভারি অহংকার। তবে সেই অহংকারটুকুই আমার প্রতিবেশী... অন্ধকার। অন্ধকারে তো চোখে বিষম দায়, so মনে মনে একটাই প্রকল্পনা: কখন পৌঁছুব দিগন্ত প্রদেশে আঁকা স্বপ্ন-বন্য-সমাচ্ছন্ন শরণার্থী শিবিরে?

শূন্যতার ভয় ফিউশন শূন্যস্থান পূরণ হবার ভয়

শূন্যস্থান পূরণ হয়ে যায়, এটা অংকের নির্দেশ।
শূন্যস্থান পূরণ হবার সিকোয়েন্সেই টেলিফিল্ম শেষ আবহমান সবচে বড় শূন্যস্থান পূরণ করে কে? আকাশ। উত্তর সঠিক। মায়াচ্ছন্ন নীল শূন্যস্থানকেই মনে করা হচ্ছে আকাশ। যখন আকাশে ওড়ে কয়েকটি কল্পনার হাঁস, ওড়ে উল্কার আলো... ওড়ে কিন্তু শূন্যের মধ্যেই ওড়ে। এভাবে, হাঁসগুলো পাখি-পাখি-উল্কার আলো শূন্যতা পূরণ করে চলে। শূন্যতা পূরণে সচেষ্ট সাঁওতালি মেঘ, চন্দ্রাবতী সরোবরে নক্ষত্রের সংসার। হয়তো কিছুটা ঝাপসা করে হলেও পিতামহের মৃত্যুর অনেকদিনের কবরের পাশের আমগাছটাকেই পিতামহ মনে হয়। কারণ কী এই যে, শূন্যতা সঞ্চয় এক বিপদজনক নেশা। হররেটিক এই নেশায় আত্মঘাতি হবার প্রেরণা লুকিয়ে থাকে। সচরাচর, সঞ্চিতা চলে যাবার পর সুকু, সঞ্চিতাহেতু আতিকের শূন্যস্থান পূরণ করে। আবার জাপানপ্রবাসী শিপু প্রদত্ত সুকুর শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে আতিক। ওদিকে সুদূর শিপুও এখন বাংলা শেখাচ্ছে তোসিকো-তমিয়োকে... এ হেন আমার বেলায়? শতশত বর্গফুট ফাঁকা ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে পড়ে আকাশ, আমার অপরিসীম শূন্যতা। এইসব শূন্যস্থানের শূন্যতা আসছে দূরদূরান্ত থেকে, দল বেঁধে, সিঙ্গেলিও, হতে পারে প্রেমিকমনের সংরাগমিশ্রিত বিস্তৃত কাজলী বিলের জেগে ওঠা জ্যোৎস্নাবিদ্ধ চরাচর থেকে শূন্যতা এসে এক অগোছালো বাস্তুজীবন ভরিয়ে তুলছে। আর কে না জানে, একা মানুষের জীবন ও বাস্তবতা কী ভয়ানক আধিজৈবিক, অলৌকিক বীভৎসতায় ভরা। দেখি, সারাক্ষণ শূন্য শূন্য আর শূন্যস্থান পূরণের আকাঙ্ক্ষায় আমার ঘড়ির কাঁটার অঙক-নির্দেশ মোতাবেক রাতের পর দিন আসে, দিনের পর রাত...

এই রাতের পঞ্জিই আমার হেডেক, অস্বস্তিদায়ক। হয়তো আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি, একা। পুরো ফ্ল্যাট ফাঁকা। ক্ল্যাসিক্যালি প্রয়োজনের অধিক শূন্যতা। জানি, মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে এসব কথার জায়গা হওয়া কঠিন। আমি দেখি যে, এক রাক্ষুসী সারারাত ড্রইংরুমের কার্পেটের ওপর ঘুমিয়ে আছে, ঠিক নববধূ-বসন্তকালে মা যেমন আমার বাপের ঘরে ফেরার অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ত। আবার হয়তো দেখি, রূপকথায় পড়া এক ডাকাবুকো প্রেতিনী আউলা কেশবিন্যাসে বারন্দায় বসে আছে। ভাবটা এমন, বারান্দার শূন্যস্থান সে স্বেচ্চায় পূরণে ইচ্ছুক। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, শূন্যস্থান পূরণের এক অঙ্কে, এই লীলায় আমার মনোজগতে ব্যাপক ভয় ঢুকে পড়ছে। ভয় হচ্ছে, আগামীকাল সকালে তো আমি বাইরে যাব, রাতে একসময় ফিরেও আসব। এসে যদি দেখি, আমার বিছানায় শূন্যতা পূরণকল্পে শুয়ে আছে এক সোনালি মোহ, ডানাকাটা সুন্দরী, সাবান-বিউটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী কিংবা ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রীর ছদ্মবেশে লাইব্রেরিতে পরিচয় হওয়া এক নিটোল ডাইনি, চুম্বনের স্কোপ থেকে যার একান্ত সংকল্প পুরুষের শাস-প্রশ্বাস শুষে খেয়ে বেঁচে থাকা, তাকে হার্টফেল করিয়ে হত্যা! তাহলে কি হবে? হায় শূন্যস্থান!!

দিনে দিনে আমি শূন্যপতি হয়ে যাচ্ছি। অডেল, এই ঘোর শূন্যতা অঘোরে পূরণ হয়ে যাবে, আমি মরে যাব- এই আশঙ্কায় লাস্ট সিকোয়েন্সেই পুলিশ এসে পড়বে কিন্তু আমাকে প্রটেকশন না দিয়ে উল্টো তারা বলতে পারে, ‘আপনার ঘরে অবৈধ শূন্যতা আছে, আপনি শূন্যতার চোরাকারবারি করেন, কনস্টেবল, হাতে হ্যান্ডকাপ লাগাও।’

Tuesday, August 11, 2009

বর্তমান কালের কবিতা

বলেন তো, তরমুজ কেন বালির ওপরে ফোটে?
মোগরভাই মুরগি আপাকে দেখলেই
মাটিতে কেন শস্যদানা খোঁটে?

বলো তো, গ্রীষ্মপ্রধান প্রশ্নগুলো
রসের উত্তরের আশায় কেন আরো
পিপাসা যেদিকে, ছোটে?

বল না, তরমুজ কেন বালিতে বলিতে ফোটে?
ফুল থেকে মৌচাকের দূরত্ব কতদূর?
প্রশ্ন, মরে মাথা কুটে!

কে মধু জমায়, কে মধু লোটে?

ঝাঁ ঝাঁ ঝিঁঝিঁ

ঝাঁ ঝাঁ দুপুর ঝাঁঝাঁ!
দুপুর মানে ঝাঁঝাঁ জানে
দুপুর রোদের রাজা...

রাজার মনে খুব দুঃখ
বিকেল নেমে আসে,
দুপুর রাজা সন্ধ্যারাণীর
সঙ্গ ভালোবাসে;
রাজা
পথ দেখিয়ে যায়।
দুপুর থেকে দুপুর হয়ে
দাঁড়িয়ে একঠায়
এদিকে আমি দুপুর হয়ে যাই!

আর যা লিখি বৈতালিকী
সুরধ্বনি, মূর্চ্ছনা কি নাই?
মুহূর্ত যে কাহাকে বলে, ঝিম-এর মেয়ে
ঝিঁঝিঁ ধরেছে পায়-
আমি ঝিঁজিঁ ধরাতেও খুশি...

ঝাঁ ঝাঁ দুপুর ঝিঁঝিঁ সন্ধ্যা
দাউ দাউ, না মৃদুমন্দা
অনেক আগুন ছাই গুণাগুণ
সিদ্ধিতে
আমার ঠোঁটে পুষি;

আমি পোষণ করি যা যা-
ঝাঁ ঝাঁ দুপুর ঘূর্ণিঘুঙুর
ঝাঁ জাঁ ঝিঁঝিঁ ঝাঁ ঝাঁ...
হাওয়ার মধ্যে হাওয়াকে তুই দুই আঙুলে বাজা।

বয়ান

সম্প্রতি, একদল মানুষ- সহযাত্রীরা যাদের এক-এক করে আধামৃত ফেলে ছিল ভূমধ্যসাগরে; তারা বাঙালি ছিল। তাদের ভাষা বাঙলা। সমুদ্রে ফেলে দেবার আগে, সেই অন্তিমমুহূর্তে তাদের কারো আর্তনাদ, কারো অসহায় বাক্য আমরা শুনতে পাইনি। কিংবা সাহারা মরুভূমির বালিবিন্দুর মধ্যে যে বাঙালিরা হারিয়ে গেল, মোদ্দাকথা যে বাক্য ভাগ্যান্বেষণে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মরল, যে বাক্য বাংলা, নিহত হলো অজ্ঞাত দেশে, আমি সেই বাঙলা ভাষাতে লেখালেখি করি। আমার বাক্যও ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়েছে, আজ আমিও চাই তারা কবিতায় ডুবে মরুক।

এদিকে র‌্যাব যতই আমাদের ভাইগুলোকে ক্রসফায়ারে মরুক, উন্মাদনা যতই আমাদের মমতার বোনকে ছিঁড়ুক, কিংবা রাতের পুলিশ নক্ষত্রদের যতই আসামি ভেবে আকাশের দিকে বন্দুক তাক করে থাকুক, ডিভি-লটারি দেওয়া দেশের মানুষ যতই সাম্রাজ্যবাদী দাঁত কেলিয়ে বসুক আমাদের মাথার উপর, বিশ্বায়ন যতই আমাদের বেশ্যায়নে নিয়ে যাক, কিংবা যতই ক্ষুধা নামক এক মারাত্মক প্রাকৃতিক-অস্ত্র কোনো তরুণকে বিমানের চাকায় পিঠে করুক- এসবের মধ্যেও কোনো এক সময় নাম বেঁধে দেয়া বসন্তঋতু আসছে। প্রতিবছরই আসে। কবিরাও স্ট্যান্ডবাই। লেখা হয় বসন্তের কবিতা।

তার ওপরে কোকিল একটা পুরোমাত্রায় বেয়াদপ পাখি। কু-উ-উ বলে এমন একটি টান মারে যে, যার ফুঁসফুসে ঠিকঠাক বাতাস ঢোকে না, তারও বুকের মধ্যে একটা খর্খরে ঘূর্ণি শাই শাই করে ওঠে। এই সময়, ফুলটুলও যথেষ্ট ফটোজেনিক হয়।

সাহিত্য সম্পাদক বসন্তের কবিতা ছাপান। আমরাও বসি, অঁলিয়স ফ্রাঁসেজে, বসন্তসন্ধ্যার ক্যাফেতে।

কিন্তু দিন দিন, আমার চিন্তারেখারা যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে এসব লেখাকে আর কবিতা বলা যাবে কিনা- প্রথম প্রশ্নটা আমিই করছি। কাজেই, আমি কবি হতে যাব কোন দুঃখে? আমি যা করি, আমরা চিন্তার ফলন ঘটাই। এ ব্যাপারে শব্দ-বাক্য-ভাষা হেল্প করে। ‘কবিতা’ শব্দটিই হয়তো আমার লেকার বিষয় হয়ে উঠছে। অন্য বিষয় যদি মাথায় না আসে তো কি করব?

এবারে সান্ধ্যভাষা- সমস্ত আহত মনের জন্য বিরল শুশ্রূষা, একামনের জন্য চড়ুইপন্থী দাম্পত্য এবং আমার মতো যারা পুরুষ বাবুই- আমা করি বসন্ত যার যা পাওনা মিটিয়ে দেবে। ফলে এই সন্ধ্যায়, বসন্তকে আলটিমেটাম দিচ্ছি, খর্খরে বাতাস বেশিদিন সহ্য করা হবে না- এভাবে মনোজাগতিক সন্ত্রাস ঘটাতে থাকলে, দায়িত্বশীল র‌্যাবও শেষে খবর পেয়ে যাবে। বসন্ত ক্রসফায়ারের মারা পড়বে। ইতোমধ্যেই অনেক বসন্ত মারা গেছে। তাদের জন্যে শোক পালনের দরকার নেই।

অ্যাথলেটিকস্

বাঘ আসছে দেখেই
হরিণ দিল দৌড়

চোখে না পড়লেও, জানি
সময় দৌড়াচ্ছে
বছর বছর
মেঘ দৌড়াচ্ছে
মেঘ কুরঙ্গগঞ্জন

যুদ্ধাহত, খোঁড়া- তবু
পিছিয়ে পড়ছে মন?

বসে থাকলে খাবে বাঘে
যে- যার কিছুটা আগে
সব্বাই দৌড়াচ্ছে মনে-প্রাণে।

শুধু দৌড় শব্দটিই
অনড় নিশ্চুপ, শুয়ে ঘুমোচ্ছে
বাংলা অভিধানে!!

শরীর ভরা দিন

ঘরের মধ্যে নদী
বারান্দায় কাশবন
জানালা পর্দাহীন
(দেহে) সোনালি যৌবন-
দরজা দিয়ে মেঘ
আড্ডা দিতে আসে
ভেন্টিলেটর... গাছে (গাছে)
চড়ুই ভালোবাসে

ঘরের নদী, তোমার
শশীর ভরা দিন
নদীর তলদেশে
আমার সাবমেরিন
কেন পাঠাব না?
ডিক্লিয়ার্ড... যুদ্ধ!
চড়ুই মতবাদে
(নো) বিবেকানন্দ, বুদ্ধ

তুমিও নদী, নদীর
শরীর ভরা ঢেউ
এসব লেখার পাঠক

অনেক? (না) একজন কেউ?

সংস্কার কর্মসূচি

কবিতা আবার দেখা হবে
তুমি তো রতন, পাড়াগাঁয়ের!
আমি কী পোস্টমাস্টার, তবে?
কবিতা তোমার মৃত মায়ের
গোপন প্রেমিক ছিলাম আগে
তাই আর বিয়ে করিনি পরে
কবিমন উদয়াস্তরাগে
কী যেন ছাড়তে চেয়েই ধরে...

তোমাকেও ছেড়ে যাচ্ছি আমি
কবিতা রতন- কচিডাব
কবিমন আমার চেয়েও দামি
গুডবাই আত্মঘাতি ভাব...

ওয়েলকাম কবিতাবিহীন দিন
গুডবাই আঁধার খেঁকো ঋণ
গুডবাই জলোষ্ণ জলপিপি

বাইবাই কোকিলফোকিল কুহু
টা... টা... টানাপড়েনের ঘোর
ফর এভার জলাঞ্জলি, হুহু
আজ তো নতুন একটি ভোর-
ভোরের রোদের ইশতেহার
এ বছর বেচব কবিমন
এ বছর মনবেচা সংসার
এ বছর ভাঙব অনশন
এ বছর ধণুকভাঙা পন
ঠণ ঠণা ঠণ ঠণ...
ঠণ ঠণা ঠণ ঠণ...

লাভার বন্ড

সব অক্ষর ঔপনিবেশিক
সব শব্দই সম্রাজ্যবাদী
নিঃশব্দে আমার গান, গল্প, নিঃশ্বাস
সম্পূর্ণ তামাদি-
তাই বাঁচার আশা নাই
প্রেস বিজ্ঞপ্তি উড়ে যাচ্ছে হলুদ খয়েরি পাতায়;
প্রেম বিজ্ঞপ্তি পুড়ে যাচ্ছে মাথায় আগুন
এতেই ভুল হয়ে গেল (বউয়ের বিকল্প বই! ইস)
মধুবাক্য মনে করে সারারাত বাক্যভরা বিষ
আর প্রতিশ্রুতিময় বাক্যভরা ধুন...

এসব তো সবই জানে আমার যমজ, সময়
রিয়েলি, শীত ইজ নট ম্যাটার
বাই এ গ্রেট ফ্যাক্টর- শীতের পরে বসন্ত আসছে
বসন্তেই ঘূর্ণিচক্রের বেশি বেশি ভয়
রঙিলা সন্ত্রাসে বধূয়া বাতাসে উপর্যুপরি বিবাহ প্রস্তাব
অবস্থা বিব্রত...
এরপরও লাভার বন্ড ইমেজ টিকে থাকতে পারব তো?

মনে সন্দেহের পাহাড়, খাদ, গর্ত, লুব্ধ প্রলয়
ভালোবাসা মাথায় উঠে যাচ্ছে, লাই পেয়ে পেয়ে
দিয়ে দিয়ে প্রশ্রয়...

যুদ্ধবার্তা

আমার অনেক কবিতার মা এক আনবিলিবেবল সম্রাজ্ঞী। তিনি এক শহরে থাকেন কিন্তু আমার সঙ্গে থাকেন না। এতে আমার কিছুটা খারাপ লাগে, কারণ কবিতাগুলো হয়তো একা একা হয়ে যাচ্ছে, কবিতাগুলো হয়তো আস্তে আস্তে এতিমগোছের বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে।

আর আমি, সীমান্তযুদ্ধে আহত হয়ে শুয়ে আছি শরণার্থী শিবিরের তাঁবুতে। কোন সীমান্তে যুদ্ধ আমার? কই, কোনো পত্রিকাই তো এই যুদ্ধের খবর ছাপল না। টিভি-সাংবাদিক তো ছুটে আসল না? যুদ্ধ কোথায়?

যুদ্ধ হচ্ছে। কোথাও না কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে। আমি যে যুদ্ধ আহত এখন, এই যুদ্ধ কভার করার মতো জার্নালিজম-ডিসিপ্লিন এখনও তৈরি হয়নি। শেষমেশ আমিই দায়িত্ব পালন করি- আমার স্টোরিগুলোর ডাক নাম কবিতা। এই কবিতা সীমান্ত যুদ্ধের শব্দে শব্দে রচনা।

আর আমার যুদ্ধ সেই সম্রাজ্ঞীর বিরুদ্ধে, যুদ্ধে যার পরাজয় হলেও আমি ব্যথিত হব বলে এখনও চূড়ান্ত আক্রমণ করিনি। কিন্তু যুদ্ধ চলছে। মেঘ নিজে দূতিয়ালি করছে। আমার আর সম্রাজ্ঞীর মধ্যকার বার্তা মেঘ বয়ে নিয়ে যেতে যেতেই তা কবিতা হয়ে উঠছে। মেঘ আছে তো কবিতা আছে। সম্রাজ্ঞী কবিতার মা, যেভাবে, আমি কবিতার বাপ। কিন্তু বাপ-মার সঙ্গে না থাকলে কি বাচ্চা-কাচ্চারা ভালো থাকে? আমাদের কবিতারা ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান। ঠিকমতো লেখাপড়া করে না, নেশা-টেশাও ধরতে পারে। হয়তো মনের কথা কাকে বলবে, ভেবে পায় না।

লোকে ভুল করে। আমাকে বলে কবি! আমি কেন কবি হতে যাব? আমি তো কবিতার বাপ। এক আনবিলিবেবল সম্রাজ্ঞী তার মা। আমাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবার্তা চালাচালি করছে মেঘ।

আর কবিতা জন্ম হচ্ছে, নেশা-টেশা করে মরছে, পাঠ্যসূচিতে মন বসাচ্ছে না। যথার্থ অভিভাবক খুঁজে পাচ্ছে না বলে কবিতারা বাপ হবার মতো পাঠক খুঁজছে, হয়তো মা হবার পাঠিকা খুঁজছে।

গার্লফ্রেন্ড খুঁজছে না?

Sunday, August 9, 2009

ফতোয়া ২০০২

ওই ছায়াবিনীকে পাথর ছুঁড়ে মারা হোক
মাটিতে অর্ধেক পুঁতে
যে আমাকে বিভ্রম করে ঠা ঠা বনভূমির মধ্যে ফেলে গিয়েছে
বাঘের থাবার নিচে, আমাকে বলেছে শুতে...

ওই মায়াবিনীকে দোররা মেরে শাস্তি দেয়া হোক
সবাই দেখুক তাকে
যে আমাকে তেষ্টাক্লান্ত করে ঝাঁ ঝাঁ মরুভূমির মধ্যে রেখে গিয়েছে
নদীর লোভ দেখিয়ে, বালি-বালি ঢেউ-বাঁকে

ভূমি থেকে ভূমিতে, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য, বিধ্বংসবিলাসী
পরমাণুর ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়ে, ছায়াবিনী-আমাকে পৃথিবীর
পরাক্রমশালী কোনো
নিঃসঙ্গ প্রেসিডেন্টের হাতে, স্যুটকেসের মধ্যে তুলে দিয়েছে

এখন স্যুটকেসের মধ্যে, আঙুলের টিপ খাওয়ার অপেক্ষা করছে অন্তিম
সেই অলৌকিক বোতাম
ভস্ম হবার প্রতীক্ষা করছে পুণ্যলতায় জড়ানো প্রেম, বিশেষ প্রতিভা
পুঞ্জিত শিরোনাম
কবিজ সাফল্য এবং
সমবেত স্নেহ-মায়া-মমতা ও শিশু জন্মাবার কাম...

মায়াবিনী আমাকে নিঃশর্ত নিরস্ত্রপরায়ণ আত্মসমর্পণের স্বাক্ষর করিয়েছে
বিপণ্নপ্রধান, বিষণ্নপীড়িত এক যাবজ্জীবন উপহারস্বরূপ গূঢ় কিছু কাচমুদ্রা
যথামৃত পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছে

ওকে পাথর মারা হোক
ওকে দোররা মারা হোক

নৈশদ্রোহ

দিনের ফেরারি বন্ধু
রাতের জুয়াড়ি, ব্রাদার
আমিও পড়ে গেলাম
প্রেমে, পরস্ত্রী; রাধার
আগুনে রাখলাম ঠোঁট
প্রেমই বংশের পেশা
দাঁড়িয়ে ঘুমাই, যথা
কণ্ঠের মদির হ্রেষা
পূর্বপুরুষ মাঠের
তুমুল জোসনাখোর
ছিল তার প্রমাণ আমি
রূপলাবণ্যচোর
চুরির নেশায় ঘুরি
শিল্পও করি, বশের
দ্বন্দ্বে মজে মাজুল
ফুল ও ফুলের রসে
গান, পিপাসার দাহ
জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে
পিপাসা বাড়িয়ে দিলে
নদীর দিকে ছোটে
আমার পুরো দেহে
দেহের মধ্যেই থাকি
দেহ নৈশদ্রোহী হলে
দ্রোহটা কই রাখি?

মেঘঅলা, বাঁশিঅলা

আত্মঘাতি মেঘ, তাতেই বৃষ্টির মহিমা
তাকাচ্ছে মেঘঅলা!
বিদগ্ধ মরুর ছবি, ওয়াটার কালারে
আঁকাচ্ছে মেঘঅলা!!

ক্ষতরা বাঁশিতে বেজে ওঠে, কোথাও
বাজাচ্ছে বাঁশিঅলা!
ফণারা ছন্দে নেচে ওঠে, সুরে সুরে
নাচাচ্ছে বাঁশিঅলা!!

বাঁশিঅলা, তোমার পেশা কি? বলো
মেঘঅলা, কী করে খাও?
বাঁশবন উধাও... সো হোয়াট? প্লিজ
বাঁশিঅলা ফুসফুস বাজাও...

নিঃসঙ্গের ছদ্মবেশে

মানুষের ছদ্মবেশে থাকি, আদতে রাক্ষস!

একদিন রাক্ষসপুরীতে ছিলাম। কিন্তু রাক্ষসদের সঙ্গে আমার বনিবনা হতো না। সবসময় খিটিমিটি লেগে থাকত। ভালোবেসে যে রাক্ষুসী আমার পাশে ছায়াচ্ছন্ন দাঁড়িয়েছিল, এক সন্ধ্যার অজান্তে তাকে অন্য রাক্ষসেরা ভক্ষণ করে ফেলেছিল। মনের দুঃখে, স্বপক্ষত্যাগী আমি মানুষের ছদ্মবেশে মানবসমাজে চলে এসেছি। আমিও কবিতা লিখি...

এই হচ্ছে মানুষের মধ্যে থেকেও আমার নিঃসঙ্গতার সংগোপন ইতিহাস। এই হচ্ছে মানুষের সমাবেশে থেকেও আমার মানুষ হতে না পারার ইহলৌকিক যন্ত্রণা। কারণ, সৌন্দর্যলুব্ধক এক মোমের মানবীকে ভালোবাসতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমি গোত্রান্তরিত রাক্ষস। স্বগোত্রে আমার জন্য এক রাক্ষুসী আত্মাহূতি দিয়েছিল। আর এদিকে আমি মোমের মানবীতে হাত ধরে আবেগে-আবেগে- যেই বলেছি, রাক্ষুসী, প্রিয়ে, তোমাকেই আজ ভালোবাসি, তুমি আমার পাশে দাঁড়াও; কিন্তু সে ভয় পেয়ে ছিটকে পালায়, আর

রাক্ষসের ভয়ে মানবীরা চিরকাল ভীত বলে আমি নিঃসঙ্গ হয়ে যাই, যথাক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে উঠি। নিঃসঙ্গতা এমন একটি উদাহরণ, যে-কেউ গ্রহণে অনিচ্ছুক... হায় রে এমন নিঃসঙ্গ থাকি

সকাল থেকেই একটা শালিক কার্নিশে ভিজছে- স্থিরচিত্রে, নিঃসঙ্গের ছদ্মবেশে আমি এখন ওই ভেজা শালিক পাখি

শালিকের ছদ্মবেশে কবিতা লিখি!

সিনেমা স্বপ্ন

নদী যদি হয় রে ভরাট, কানায় কানায়
ঢেউঅলা প্রস্তাব করি, ইচ্ছা
সাঁতার নামে একটা জলজ্যান্ত
সিনেমা বানাই

সিনেমার সেন্ট্রাল লোকেশন এই নদী
প্রধান চরিত্রে ঐশ্বরিয়া থাকত, ঐশ্বরিয়া
রাজি হতো যদি

আমিই হচ্ছি পরিচালক, এই সিনেমায়
একক চরিত্রের অভিনয় সমৃদ্ধ একটি জটিল চিত্রনাট্য
চোখে নিয়ে আমি বসে আছি নদীপাড়ে

বি.দ্র. ছোটবেলা থেকেই নদী দেখলেই সাঁতার আমার পাঠ্য
সাঁতারের মজা লাগে আমার চামড়ায়, বডিতে, হাড়ে

বহুদিনের সাধ, সাঁতার একটা সিনেমা-স্বপ্ন
এদিকে তুমি হেভি প্রফেশনাল, ব্যস্ত তারকা, অভিনেত্রী
চরিত্রের প্রয়োজনে জল হয়ে গেছ, নদী হয়ে গেছ
ভরে গেছে কানায় কানায়

এই দৃশ্য দেখতেই তো পাড়ে বসে থাকি
ইচ্ছে সাঁতার, তোমার কিংবা জলপাখিদের জীবন থেকে নেয়া
লাভস্টোরি বানাই...

পরিপ্রেক্ষিত, তস্কর-প্রেমিক

বাক্য তুই বড় হ, খাতার মধ্যে
মাথার মধ্যে মাঠ, জনপদ, দেশি নদী
বাক্য ভরা মধু, মক্ষী, আশা, ভালোবাসার পরিমাণ
কমে গিয়ে কখন যে বেড়ে উঠল বিষ, সন্দেহ

ফলে, যতই আমি শব্দ মান্য করি, শব্দ আমাকে হেয়
করে চলে যায় দুপুর-আশ্রিত ঘূর্ণিমুগ্ধতার
রেশ ধরে নিঃশব্দ অবধি
মহাঅন্তঃপুর!

বাক্য তুই বউ হ, বলি যতই আতিপাতি করে বলি
সে উদ্দেশ্য-প্রণোদিত দাঁড়িয়ে থাকে গলিমুখে
তার কণ্ঠে নিষিদ্ধ সুর
তার মধ্যে ডাইনির শ্বাস-প্রশ্বাস, নটিনীর নূপুর, ঘুঙুর

সব সময় আমার এই একটা সন্দেহ
বসন্তরাতের অঢেল জোছনায় তস্কর-প্রেমিক হতে গিয়ে
অ্যাকচুয়ালি আমি অসহায় সারমেয়

এই জন্যে, দেহের ভেতরে মন পাচ্ছি না
মনের ভেতরে দেহ
তস্কর-প্রেমিক আমি, শুক্লপক্ষেও উপায়হীন
স্মৃতিভুক সারমেয়...

কাজের বুয়ার সঙ্গে প্রেম

ফাইনালি, প্রেম হচ্ছে ছুটা বুয়া, কদিন আগেও আমার বাসায় কাজ-কাম করত। ভোরবেলা বুয়াই আমার ঘুম ভাঙিয়ে, ঘরদোর মুছে, রাতের এঁটো প্লেট পরিষ্কার করে, আমার জামা-প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার, মোজা কেচে দিয়ে যেত। এছাড়া ডিম-পরোটা তো হতোই; গরম গরম...

সেই প্রেম, সেই বুয়া ছুটে গেছে। এখন সে অন্য বাসায় কাজ-কাম করে সে আর আমার বাসায় আসে না, তাই আমার ঘর আবর্জনায় ভরে যায়।

কিন্তু মাঝেমধ্যেই প্রেমবুয়াকে দেখি; সে কাঁটাবনের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, রিকশায় করে যাচ্ছে... হ্যাঁ, প্রেম রিকশায় চড়ে যাচ্ছে এবং হঠাৎ প্রেম অথবা সেই বুয়া আমার দিকে তাকিয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছে যে, এখন আমি অন্যের কাম করি, আপনার করি না...

ছুটা বুয়াদের তাই দূর থেকে দেখি; এদিকে আমার ঘর ডাস্টবিন হয়ে যাচ্ছে, এঁটো প্লেট ধোয়ামোছা হচ্ছে না, কাপড়চোপড়ে ময়লা শুকিয়ে যাচ্ছে। কতদিন হলো গরম গরম ডিম-পরোটা খাচ্ছি না

ভোরবেলা, বাসায় কলিংবেলের সুইচে সে চাপ কিংবা টিপ দিচ্ছে না... আমার ঘুম ভাঙিয়ে কাজ-কাম করছে না। এদিকে প্রেম তো হচ্ছে না; কিন্তু প্রেমের কবিতা ঠিকই লিখতে হচ্ছে...

Saturday, August 8, 2009

১৪১৪ : সারাবছর বসন্তকাল

বলেইছি তো, থাকব বলে
বাঁধছি হাওয়াঘর-

পতন ভালোবাসি বলে
তুমি পাতাটি বউ পাতা আর
আমি পাতা বর...
আমরা না-হয় উড়েই যাব
উঠলে ঘূর্ণিঝড়!

আমরা না-হয় পুড়েই যাব
সারাদুপুর খা খা
এও কি সম্ভব যে
বালির ওপর বনভূমির
স্বপ্ন, সবুজ আঁকা?
পাখি হতে তো পারব না, তাই
পাতা হয়েই থাকা...

বলেইছি তো, মরব বলে
ভালোবাসার বিষে-
আমরা দুটি পাতা যদি
পরষ্পরে মিশে
ভালো থাকি তো কি প্রবলেম
কী এসে যায় কার?
বাংলাদেশে এই প্রথম এক
পাতার সংসার...

খ.
ময়ূর বাগান এত বৃষ্টি, এই যে এত বৃষ্টি খাই বাঁচি।
বাসায় ফেরার পথে ফলো করে ডার্কনেস, আমি আছি
মন-মহাদেশে, যেখানে বৃষ্টি নেই, বন্ধুরাও জানে
ব্যাপক বৃষ্টিতে ভিজব বলে, দিনশেষে, সন্ধ্যায়, ময়ূরবাগানে
কেন আমি যাই আর কাচের পাত্রে ঢেলে বৃষ্টি ফোঁটা খাই?
আশরীর যে ভেজাব আমি, চলতি মেঘে তো বৃষ্টিকণাই নাই?

অথচ আমার চতুর্পার্শ্বেই মেঘ আমি মেঘের নিচে হাঁটি।
মেঘ আমাকে ফোন করে আর কথা বলে, করে কান্নাকাটি
মেঘের পাশে ঘুরি আমি অ্যাডাল্ট বলে মেঘের পাশে শুতেও
কিন্তু ইচ্ছা করে, ভাবনাগুলো কিচ্ছা করে বৃষ্টিহীন রাতের গলি
পেরিয়ে গিয়ে ঘরটা যখন খুঁজে পাই না, মেঘ তোমাকে বলি-
বঙ্গদেশে বৃষ্টি কেন নেই? বৃষ্টি ছাড়া তুমি একটা খুনি
কি আর করা, টলতে টলতে হাঁটি, নদীতীরের
জলহীনতার প্রমাণস্বরূপ চরের বালি, হঠাৎ দেখি তরমুজ ক্ষেত-
তার মানেই তো বৃষ্টি হচ্ছে, ভিজে যাচ্ছি, এই স্বপ্ন বুনি...

গ.
তুলারাশির জাতক, আমি বিষ নামাতে পারি
কিন্তু আগে জানতে হবে- বিষ শরীরের কোথায়?
হাত চালানেও আপত্তি নেই, যতই পরো শাড়ি
তুমি তো জানোই- কী পরিমাণ গভীর সমঝোতা
সাপের সঙ্গে, বিষের সঙ্গে করেই তবে ওঝা
হয়ে আমি এখন তোমার মুখোমুখি, সোজা
দাঁড়িয়ে আছ, আমি বসে, তোমার পায়ের পাতায়
হাত রেখেছি, বিষ নামাতে, বিষ উঠেছে বুকে...

তুলারাশির জাতক, আমি উড়ে বেড়াই, সুখে
ঘুরে বেড়াই... ঘুর ঘুর ঘুর... তা থই থই তা তা
কিন্তু অত ধ্রুপদে না, ওঝাই আমি ভালো
সাপকে আগেই বলে দিছলাম, চুমুতে বিষ ঢালো...
বিকজ আমার তুলারাশির হাত, বিষ নামানোর ডাকে
হাত, পা ধরে উঠছে এখন ক্রমশ মৌচাকে

কোথায় আবার মৌচাক-টাক, মধুভাবনা, কি সে?
ভালোবাসার মধু থাকে ভালোবাসার বিষে
একটা দুপুর, সারা বিকাল সন্ধ্যাটাকেও খুঁজছ ফিরে পেতে
প্লিজ! নাকছাবিটা হারিয়ে গেলে, ‘কল মি’ সংকেতে